বাংলাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপ (বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভে বা বিডিএস) চলছে। এই জরিপ শেষ হলে দেশের নাগরিকদের ভূমি সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি হয়রানি ও বিপুল অর্থব্যয় রোধ করা সম্ভব হবে বলে আশা করছে সরকার। ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পূর্ণ নতুন ক্যাডাস্ট্রাল (ভূনকশা-ভিত্তিক) জরিপ চালাচ্ছে।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০২২ সালের ৩ আগস্ট পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সংলগ্ন মাঠে বিডিএস-এর পাইলটিংয়ের উদ্বোধন করেন। ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০২৬ সালের মধ্যে ‘এস্টাব্লিশমেন্ট অব ডিজিটাল ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ প্রকল্প বা ইডিএলএমএস প্রকল্পের আওতায় ছয়টি এলাকায় চলমান জরিপের প্রথম পর্যায়ের কার্যক্রম শেষ হবে। এই পর্যায় থেকে প্রয়োজনীয় আউটপুট নিয়ে দ্বিতীয় ধাপে সারা বাংলাদেশে একযোগে বিডিএস প্রোগ্রাম চালু করা সম্ভব হবে। তবে চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী সিটি করপোরেশন, মানিকগঞ্জ পৌরসভা, ধামরাই ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় ইডিএলএমএস প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভে বিডিএস কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
ভূমি জরিপ (ভূ-সম্পদ জরিপ/ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে) ঠিকভাবে না হলে তা ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদী ভোগান্তি ডেকে আনে। ভূমি জরিপের সময় মাঠ পর্যায়ের অসৎ কর্মকর্তা ও অসাধু ভূমির মালিক, দালাল কিংবা ভূমি দস্যুদের যোগসাজশে ইচ্ছাকৃত অসঠিক জরিপ কিংবা নিছক অসাবধানতাজনিত ত্রুটিপূর্ণ জরিপের কারণে, প্রকৃত মালিক ছড়া জমি অন্য ব্যক্তির নামে কিংবা সরকারের নামে চলে গেলে তার নিষ্পত্তিতে মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত যেতে হয়। জরিপকাজে এই দীর্ঘসূত্রতা ও জনগণের হয়রানি কমানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভূমি মন্ত্রণালয়কে ডিজিটাল জরিপ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
যেসব প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে
ভূমি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইতোমধ্যে যেসব এলাকায় বিডিএস কার্যক্রম চলমান রয়েছে, অথবা ভবিষ্যতে বিডিএস কার্যক্রম চলবে সেসব এলাকার জমির বা ভূমির মালিকদের কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কাছে রাখতে হবে। সেসব কাগজপত্রের মধ্যে রয়েছে– জমির দলিল ও রেকর্ডীয় খতিয়ান। জমির নামজারী করা না থাকলে অতিদ্রুত জমির নামজারী সম্পূর্ণ করে রাখতে হবে। জমির খাজনা হালনাগাদ পরিশোধ করে রাখতে হবে।
পর্চা ও নকশা অনুযায়ী জমি মেপে রাখতে হবে। জমির সীমানা আইল নির্ধারণ করে রাখতে হবে। নিজের জমি নিজের দখলে রাখতে হবে। জমি ইজমালি ও পৈত্রিক সম্পত্তি হলে ওয়ারিশ সনদ সংগ্রহ করে রাখতে হবে। প্রয়োজনে বন্টননামা দলিল প্রস্তুত করে রাখতে হবে। দরকার হলে এওয়াজ বদল করে নামজারী করে রাখতে হবে।
মনে রাখতে হবে, জরিপের সময় কোনও জমির খাজনা দেওয়া না থাকলে জমি খাস হয়ে যাবে। তাই দ্রুত জমির খাজনা পরিশোধ করে রাখতে হবে। ভূমি মন্ত্রণালয় বলেছে, যাদের জমির দলিল/কাগজপত্র ও খাজনার দাখিল নেই তাদের জমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য মন-মানসিকতা প্রস্তুত করে রাখতে হবে।
জমির মালিক কাছে না থাকলে
ভূমি মন্ত্রণালয় বলেছে, যে সব নাগরিক জমির কাছাকাছি থাকেন না তাদের তার এলাকায় বিডিএস কার্যক্রম কবে নাগাদ হতে পারে সে সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতে হবে। যারা এলাকার বাইরে থাকেন সেসব জমির মালিকদের জরিপ সম্পর্কে জানাতে ভূমি মন্ত্রণালয় কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। বিডিএস জরিপ কর্মকর্তাদের স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে জরিপ বিষয়ে প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জরিপ প্রক্রিয়া চলার সময় অনেক জমির মালিক এ বিষয়ে অবগত থাকেন না। প্রায়ই দেখা যায় জরিপ করার সময় প্রকৃত মালিক অনুপস্থিত থাকেন। তাদের অজান্তে জরিপ কার্যক্রম শেষ হয়ে যায়। যার ফলে তাদের কখনও কখনও হয়রানির শিকার হতে হয়। এসব কারণেই ভূমি মন্ত্রণালয় জমির মালিকদের নিজের জমিজমা ও বিডিএস কার্যক্রম সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলেছে।
কেন হচ্ছে এই জরিপ
এ প্রসঙ্গে ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেছেন, প্রচলিত ভূমি জরিপে যেখানে ২০-২৫ বছর লাগে, সেখানে খুব অল্প সময়ে বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপ করা সম্ভব হবে। এই জরিপ শুরুর সঙ্গে খসড়া ম্যাপ তৈরি করে ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে যাতে জমির মালিক পৃথিবীর যেকোনও স্থান থেকে তার জমির ম্যাপ দেখে জমির পরিমাণ কমবেশি হলে সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি দাখিল করতে পারবেন।
অনেক সময় জমির মালিকরা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে জমি বিক্রি করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন যে ভুলভাবে জরিপ করা হয়ে গেছে এবং অন্য কারও নামে জমির খতিয়ান গেজেট হয়ে গেছে। ফলে বৈধ মালিকদের তাদের নিজের সম্পত্তির অধিকার পুনরুদ্ধারে বছরের পর বছর আইনি ও অর্থনৈতিক ঝামেলায় পড়তে হয়। এ কারণেই জমির মালিকদের কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারা যদি এসব নির্দেশনা ঠিকমতো পরিপালন করেন, আশা করছি তাহলে ভূমির মালিকানা নিয়ে তাদের আর কোনও সমস্যায় বা জটিলতায় পড়তে হবে না।
বিডিএস ম্যাপে জমির পরিমাণ, জমির আইলের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, আকার ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যাবে। এই জরিপে তৈরি ম্যাপটিতে সেন্টিমিটার পর্যায় পর্যন্ত এই ভূমি পরিমাপের নির্ভুলতা থাকবে। পরিমাপের ক্ষেত্রে ইমেজ থেকে সুবিধামতো রেফারেন্স এর কো-অর্ডিনেটের মান ও মৌজা ম্যাপের যে কোনও পয়েন্টের দূরত্বের মাপ ও পয়েন্টের খতিয়ান নির্ধারিত দৈর্ঘ্যপ্রস্থ মাপ ও চার কোনার চারটি কো-অর্ডিনেট মান নিয়ে কনভেনশনাল ও আধুনিক ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমির যে কোনও পয়েন্টের পরিমাপ, ল্যান্ড ডিমার্কেশন, ল্যান্ড ডিভাইড করা সম্ভব হবে। দরকার হবে না আলাদাভাবে স্থাপিত কোনও রেফারেন্স জিওডেটিক পিলার তথা জরিপের জন্য পিলার স্থাপনের।
ভূমি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভূমির মালিকানার ও অধিগমনের (দখলের) ক্ষেত্রে দরিদ্র, ভূমিহীন, প্রান্তিক, নারী ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কৃষিভূমি ও জলাশয় রক্ষা ও সংস্কার প্রয়োজন। ভূমি খাত সংস্কারে খাস জমি ও চর গরিব ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে বিতরণ; শত্রু ও অর্পিত সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া; ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের ন্যায্য স্বার্থ নিশ্চিত করা; নারীদের জমি মালিকানার অধিকার নিশ্চিত করা; বঞ্চিত জনগণকে সেবা দিতে ভূমি আইনের ফাঁকফোকর বন্ধ করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্ভুল ও সঠিক জরিপ খুবই প্রয়োজন।
তারা আরও জানায়, বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভের মূল উদ্দেশ্য অল্প সময়ে সমগ্র বাংলাদেশে ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে তথা ভূ-সম্পদ জরিপ শেষ করা এবং পরবর্তীতে মাঠে গিয়ে সার্ভের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে নিয়ে আসা। এছাড়া কোনও এলাকায় প্রাকৃতিক কারণে বড় ধরণের ভূমির বিচ্যুতি না ঘটলে রিভিশন্যাল সার্ভের প্রয়োজনীয়তাও থাকবে না ডিজিটাল ম্যাপ পার্টিশনের সুবিধার জন্য। এ প্রকল্পের আওতায় নির্ধারিত জিও-রেফারেন্স-করা মৌজা ম্যাপ ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন’ প্রকল্পে সরবরাহ করা হবে। জমি বিক্রির পর নামজারি খতিয়ান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ম্যাপের সীমানা পরিবর্তন হয়ে যাবে।
যেভাবে চলছে জরিপ
সারা দেশে ডিজিটাল জরিপকরণের সক্ষমতা অর্জনের জন্য সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ভূমি মন্ত্রণালয় ১ হাজার ২১২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভের (বিডিএস) উদ্যোগ নেয়। ‘ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ করার জন্য ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের ডিজিটাল জরিপ পরিচালনার সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প’ নামে ৫ বছর মেয়াদি প্রকল্পের মাধ্যমে এই জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ে, নির্ভুলভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ করার জন্য বাংলাদেশ ভূমি জরিপ তথা বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভেতে স্যাটেলাইট, ড্রোন তথা ইউএভি এবং গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশনের সমন্বয়ে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
এজন্য তিনটি পার্বত্য জেলার বাইরে সারা দেশের ৪৭০টি উপজেলার মৌজা পর্যায়ে জিওডেটিক (নেভিগেশন, ভূ-তাত্তিক, ভূ-বিজ্ঞান ও প্রকৌশল সংক্রান্ত) সার্ভের মাধ্যমে ২ লাখ ৬০ হাজার ৩১০টি জিও-রেফারেন্সিং পয়েন্ট নির্ধারণ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ১ লাখ ৩৩ হাজার ১৮৮টি মৌজা ম্যাপের ডাটাবেজ প্রস্তুত করা হবে। ভূমিতে আগে জরিপ করা থাকলে ওই জরিপের ডিজিটাইজ ম্যাপের সঙ্গে নতুন প্রস্তুত ম্যাপের সুপার ইম্পোজের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হবে নতুন জিও রেফারেন্স মৌজা ম্যাপ। এছাড়া পরবর্তীতে, ‘মৌজা ও পয়েন্টভিত্তিক জাতীয় ডিজিটাল ভূমি জোনিং প্রকল্প’ থেকে সংগ্রহ করা স্যাটেলাইট ইমেজের সঙ্গেও সমলয় করা হবে এই মৌজা ম্যাপ।