দেশের প্রকৃতি কন্যা খ্যাত জাফলং ঘুরে আসুন এক দিনে; কম খরচে

পরিবেশ ভ্রমন গাইড সিলেট
শেয়ার করুন...

জাফলং থেকে ফিরে, সেলিম চৌধুরী হীরাঃ
প্রকৃতি কন্যা হিসাবে সারাদেশে এক নামে পরিচিত সিলেটের জাফলং। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ জাফলংকে করেছে আকর্ষণীয়। সীমান্তের ওপারে ইনডিয়ান পাহাড় টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরামধারায় প্রবাহমান জলপ্রপাত, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রীজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেলপানি, উঁচু পাহাড়ে গহিন অরণ্য ও শুনশান নিরবতার কারণে এলাকাটি পর্যটকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে।

জাফলং, বাংলাদেশের সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত যা সিলেট শহর থেকে ৬৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে, ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। ওপারে খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়, এপারে নদী। পাহাড়ের বুক চিড়ে বয়ে চলছে ঝর্ণা, আর নদীর বুকে স্তরে স্তরে সাজানো নানা রঙের নুড়ি পাথর। প্রকৃতির এই অপরুপ সৌন্দর্য দেখা যায় জাফলং এ৷

শীত ও বর্ষা মৌসুমে জাফলং এর সৌন্দর্যের রুপ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। বর্ষায় জাফলং এর রুপ লাবণ্য এক ভিন্ন মাত্রায় ফুটে উঠে। ধূলি ধূসরিত পরিবেশ হয়ে উঠে স্বচ্ছ। স্নিগ্ধ পরিবেশে শ্বাস-নি:শ্বাসে থাকে ফুরফুরে ভাব। খাসিয়া পাহাড়ের সবুজাভ চূড়ায় তুলার মত মেঘরাজির বিচরণ৷ সাথে কয়েক হাজারফুট উপর থেকে নেমে আসা সফেদ ঝর্ণাধারার দৃশ্য যে কারোরই নয়ন জুড়ায়।

আবার শীতে অন্য রূপে হাজির হয় জাফলং। চারিদেকে তখন সবুজের সমারোহ, পাহাড় চূড়ায় গহীন অরণ্য। ফলে শীত এবং বর্ষা সব সময়েই বেড়ানোর জন্য উপযুক্ত স্থান হতে পারে জাফলং। জাফলংয়ের বুক চিড়ে বয়ে গেছে দুই নদী। ধলাই ও পিয়াইন। এই নদী দুইটি অন্যন্যতা এনে দিয়েছে জাফলংকে।

ধলাই ও পিয়াইনের স্বচ্ছ জলে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় নানা জাতের ছোট মাছ। দুই নদীর পানির নিচ ডুবে থাকা লক্ষ লক্ষ বিভিন্ন রঙ্গের নুড়ি পাথর৷ সীমান্তের ওপারে ডাউকি নদীর উপরে দুই পাহাড়ের মধ্যখানে ঝুলন্ত সেতু বাড়িয়ে তুলেছে জাফলংয়ের অনেক টুকু সৌন্দর্য। পাহাড়, পানি, পাথর, ঝর্ণা সবমিলিয়ে জাফলং যেনো এক রূপকথার রাজ্য।


জাফলংয়ের সৌন্দর্য্যে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে সেখানকার আদিবাসীদের জীবনধারা। নদী পার হলেই খাসিয়াপুঞ্জি। খাসিয়াদের গ্রামকে বলা হয় পুঞ্জি। এই পুঞ্জিগুলোতে গেলে দেখা যাবে ৩-৪ ফুট উঁচুতে বিশেষভাবে তৈরি খাসিয়াদের ঘর। প্রতিটি বাড়িতে সৃজিত পানবরজ। মাতৃতান্ত্রিক খাসিয়া সম্প্রদায়ের পুরুষরা গাছ বেয়ে বরজ থেকে পান পাতা সংগ্রহ করেন। আর বাড়ির উঠোনে বসে নারী সদস্যরা পান পাতা ভাঁজ করে খাঁচা ভর্তি করেন বিক্রির জন্য। পান পাতা সংগ্রহ ও খাঁচা ভর্তি করার অভিনব দৃশ্য পর্যটকদের নজরকাড়ে। পানবরজ ছাড়াও খাসিয়া পল্লীতে দেখা যাবে কমলা বাগান। কাঁচা-পাকা কমলায় নুয়ে আছে বাগানের গাছ। সংগ্রামপুঞ্জির রাস্তা ধরে আরেকটু এগুলো দেখা যাবে দেশের প্রথম সমতল চা বাগান। পুরনো রাজ বাড়ী৷

কিভাবে যাবেন

বাসে, ট্রেনে অথবা বিমানে৷ কম খরচে ভ্রমন করতে চাইলে প্রথম ট্রেন তারপরে বাহন বাস৷ যেহেতু আমরা কম খরচের কথা বলছি, তাই বাস বা ট্রেনের কথাই বলবো৷ ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ময়মনসাংহ সহ দেশের সব জায়গা থেকে ট্রেনে সিলেট যাওয়া যায়৷
ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ২টায় ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ০৯টা ৫০ মিনিটে ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৪টায় ছাড়ে কালনী এক্সপ্রেস। ভাড়া দেড়শ থেকে ১ হাজার টাকা। টবে একদিনে ভ্রমন করতে চাইলে, ট্রেনে রাত ৯.৫০ এর উপবন এক্সপ্রেসে জাওয়াটাই সব থেকে ভালো কারন আপনার যেতে যেতে সকাল হয়ে যাবে আর আপনি যদি রাতে ট্রেনে ঘুমিয়ে নিন তাহলে সকালে ট্রেন থেকে নেমেই আপনার ভ্রমন শুরু করতে পারেনত৷ সময় অপচয় হবেনা৷ ট্রেনে সময় লাগবে ৭-৮ ঘন্টা।

চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে সিলেটঃ

চট্টগ্রাম থেকে সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে যায় পাহাড়িকা এক্সপ্রেস এবং শনিবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে উদয়ন এক্সপ্রেস। ভাড়া ১৪৫ থেকে ১ হাজার ১৯১ টাকা।ট্রেন এর টিকেট এর দাম: এসি বার্থ ৬৯৮ টাকা, এসি সিট ৪৬০ টাকা, ফার্স্ট ক্লাস বার্থ ৪২৫ টাকা, ফার্স্ট ক্লাস সিট ২৭০ টাকা. স্নিগ্ধা ৪৬০ টাকা, শোভন চেয়ার ১৮০ টাকা, শোভন ১৫০ টাকা, সুলভ ৯৫ টাকা।

ঢাকা থেকে সিলেট এর উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায় গাবতলী, কমলাপুর এবং সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে৷ বাস গুলো সকাল থেকে রাত ১২.৪৫ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময় পরপর ছেড়ে যায়৷ ঢাকার ফকিরাপুল, সায়দাবাদ ও মহাখালী বাস স্টেশন থেকে সিলেটের বাসগুলো ছাড়ে। এ পথে গ্রীন লাইন পরিবহন, সৌদিয়া এস আলম পরিবহন, শ্যামলি পরিবহন ও এনা পরিবহনের এসি বাস চলাচল করে। ভাড়া ৮শ’ থেকে ১ হাজার ১শ’ টাকা। এছাড়া শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ইউনিক সার্ভিস, এনা পরিবহনের পরিবহনের নন এসি বাস সিলেটে যায়। ভাড়া ৪শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ টাকা। এনা পরিবহনের বাসগুলো মহাখালী থেকে ছেড়ে টঙ্গী ঘোড়াশাল হয়েও সিলেট যায়।

প্লেনে সিলেটঃ

ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ, ইউনাইটেড এয়ার, রিজেন্ট এয়ার, নভো এয়ার এবং ইউএস বাংলা এয়ারের বিমান প্রতিদিন সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে যাওয়া যায়। ভাড়া পড়বে ৩০০০ থেকে ৫০০০ এর মত৷

সিলেটে থেকে বাস, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা বা লেগুনায় যাওয়া যায় জাফলংয়ে। জাফলং যেতে জনপ্রতি বাসভাড়া পড়বে ৮০ টাকা। যাওয়া-আসার জন্য মাইক্রোবাসের ভাড়া পড়বে ৩০০০-৩৫০০ টাকা। সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া পড়বে ১২০০-১৫০০ টাকা। সিলেট শহরের যে কোনো অটোরিকশা বা মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে যাওয়া যাবে জাফলংয়ে। আর জাফলংমুখী বাস ছাড়ে নগরীর শিবগঞ্জ থেকে। প্রতি এক ঘন্টা পরপর পাওয়া যাবে লোকাল বাস।


দেশের যেখান থেকেই যাত্রা শুরু করেননা কেনো, প্রথমে আপনাকে সিলেট পৌঁছাতে হবে৷ রাতে যাত্রা শুরু করতে হবে যাতে করে সকাল সকাল সিলেট পৌঁছানো যায়৷
বাহন যাই হোকনা কেন, সকালে সিলেট নেমে ঝটপট নাস্তা সেরে নিন৷ (তবে চাইলে সকালে শুরুতে সিলেট শহরের হজরত শাহাজালাল (রাঃ) ও হজরত শাহ পরান (রাঃ) মাজার ঘুরে তার পর জাফলং যেতে পারেন) রিক্সা, অটোতে ছড়ে ২০-৩০ টাকা ভাড়ায় চলে যান নগরীর শিবগঞ্জ বাস স্ট্যান্ড৷ ৮০ টাকা ভাড়ায় লোকাল বাসে চড়ে চলে যেতে পারেন জাফলং৷ সময় লাগবে ২.৩০-৩ ঘন্টা৷ মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা বা লেগুনায় রিজার্ব নিলে দরদাম করে নিবেন এবং আসপাশে কিছু দেখতে চাইলে নেমে দেখবেন বলে আগে থেকেই ভালোভাবে কথা বলে নিবেন৷ তাহলে জাফলং যাওয়ার পথে আসপাশটা দেখতে পারবেন৷
জাফলং নেমে ২০-৩০ মিঃ পাহাড়ের উপর ছোট বাজার, হোটেল, মটেল এরিয়া ঘুরে দেখতে পারেন৷ তার পর চলে যান জিরো পয়েন্টে, পাথর, জল প্রপাতে সময় কাটান৷ জন প্রতি ২০ টাকা বোট ভাড়া করে চলে যান খাসিয় পল্লি৷ সেখান থেকে জন প্রতি ৫০ টাকায় অটো ভাড়া করে যেতে পারেন চা বাগানে, পান বাগান, পুরোনো রাজ বাড়ী৷ দুপুরের আগেই ফিরে আসুন জিরো পয়েন্ট৷ কিছুটা সময় জিরো পয়েন্টে কাটিয়ে আবার ফিরে আসুন উপরে৷ (দুপরের খাওয়াটা একটু দেরীতে হবে) উপরে এসে বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট রয়েছে সেখানে ১২০-২০০ টাকার প্যাকেজে দুপরের খাওয়া খেয়ে আবারও বাসে চড়ে চলে আসুন সিলেট শহরে৷ শহরেই রয়েছে হজরত শাহাজালাল (রাঃ) ও হজরত শাহ পরান (রাঃ) মাজার ঘুরে তারপর রাতের বাসে অথবা সিডুয়েল অনুসারে ট্রেনেচড়ে নিজ গন্তব্যে চলে যেতে পারেন৷ (তবে সকালে শুরুতে সিলেট শহরের মাজার ঘুরে তার পর জাফলং যেতে পারেন৷ এতে করে পুরো বিকেলটা জিরো পয়েন্টে কাটিয়ে আসতে পারবেন৷ মনে রাখবেন, সন্ধ্যার আগেই জিরো পয়েন্ট ত্যাগ করা বাধ্যতা মুলক)৷

ভ্রমণ খরচঃ

এই একদিনের ভ্রমনে কত খরচ হবে তা স্বাভাবিক ভাবেই আপনি বা আপনাদের উপরেই নির্ভর করবে। খাওয়া দাওয়া এবং যাতায়াতই মূলত এই ট্রিপের মূল খরচ। আর একসাথে গ্রুপ করে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই খরচ কিছুটা কমে যাবে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা যাওয়ার সময় লোকাল সিএনজি/ইজিবাইক ব্যবহার করলেও খরচ কম লাগবে। এছাড়া আপনারা যদি একসাথে ৪-৫ জন হন তাহলে যাতায়াতের জন্যে সিএনজি রিসার্ভ করে নিতে পারেন, এতে সময় বেঁচে যাবে।

ঢাকা থেকে এক জনের জাফলং ঘুরে দেখার একটা আনুমানিক খরচের হিসেব নিচে দেওয়া হলো

ঢাকা থেকে সিলেট ট্রেন ভাড়া যাওয়া ও আসা – ২০০x২ = ৪০০ টাকা৷
ট্রেন থেকে নেমে বাস স্ট্যান্ড যাওয়া ও আসা – ২৫x২= ৫০ টাকা৷
সকালের নাস্তা ৫০ টাকা৷
সিলেট থেকে জাফলং বাস ভাড়া যাওয়া ও আসা ৮০x২= ১৬০ টাকা৷
জাফলং নদী পার হতে যাওয়া ও আসা ১৫x২= ৩০ টাকা৷
পুরনো রাজ বাড়ীতে যেতে অটো ভায়া যাওয়া ও আসা ৫০x২=১০০ টাকা৷
দুপুরের খাবার ১৫০ টাকা৷
বিকেলের নাস্তা ৫০ টাকা৷
সিলেট শহরে ঘুরাঘুরি (মাজারে যাওয়া) রিক্সা ভাড়া ১০০ টাকা৷
রাতের খাবার ১৫০ টাকা৷
অন্যান্য টুকিটাকি খরচ আরো ৬০ টাকা৷

ঢাকা থেকে জাফলং জন প্রতি সর্ব মোট খরচ খরচ ১৩০০ টাকা৷

বিঃ দ্রঃ ঢাকা থেকে বাসে সিলেট গেলে (বাস ভাড়া বাবত) খরচ বাড়বে ৪০০ টাকা৷

এক রাত থাকা হলে দ্বিতীয় দিনে রাতারগুল, বিছানাকান্দি, শহরের অদূরে চা বাগান সহ কিছু স্থান ভ্রমন তালিকায় যুক্ত করে নিতে পারেন৷


শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published.