গোলাম রাব্বানী, নওগাঁ
বউ ধান বানে রে ঢেঁকিতে পা দিয়া, ঢেঁকি নাচে বউ নাচে হেলিয়া দুলিয়া, ও বউ ধান বানে রে, গ্রামীণ এই ঐতিহ্যবাহী লোকজ গানটি আর তেমন শোনা যায় না। আশির দশকের আগে গ্রামের প্রায় বাড়িতে গ্রামের বধূরা সুর তুলে মনের আনন্দে গান গাইত আর ঢেঁকিতে ধান বানাতো। এখন আর চোখে পড়ে না ঢেঁকিতে পাড় দিতে দিতে গ্রামীণ বধূদের এই গান গাওয়ার দৃশ্য। কালের পরিবর্তনে গ্রাম-বাংলা থেকে এই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি আজ বিলুপ্তির পথে।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিন দিন ঢেঁকির কদর গ্রাম-বাংলার কৃষকদের বাড়ি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। হাতে গোনা কিছু কৃষকের বাড়িতে ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি এখনো চোখে পড়ে। মান্দা উপজেলার ভারশোঁ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান সুমন সেই পুরান ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য গ্রামে গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় ঢেঁকি বিতরণ করছে। এই ঢেঁকি পেয়ে গ্রামের পরিবারের মহিলারা ঢেঁকিতে ধান ছাঁটাই কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে।
তাদের মতে, ঢেঁকিতে চাল ছাঁটার গুণাবলীর মধ্যে অনেক গুণ আছে। ঢেঁকিতে ছাঁটা চাল পুষ্টিতে ভরা থাকে। চালের ওপর যে লাল আবরণ থাকে তা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারি। সেজন্য ভারশোঁ ইউপি চেয়ারম্যানের দেওয়া ঢেঁকি সেকাল থেকে আমরা ঢেঁকি ব্যবহার করে আসছে।
ঢেঁকিতে পাড় দিলে এক ধরনের কায়িক পরিশ্রম হয় যা স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয়ামের একটি অংশ।
বর্তমান সময়ে মানুষ ধান, চালের আটা ও চিড়া ভাঙানোর জন্য বৈদ্যুতিক মিল হওয়ায় কৃষকরা সহজেই ধান, আটা ও চিড়া কম সময়ে ও কম খরচে ভাঙাতে পারছেন। তাই এখন আর বাড়িতে ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি রাখছেন না কৃষকরা। তারা বৈদ্যুতিক মিলের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ছে। ঢেঁকিতে বানা ধানের চালের ভাত, খিচুড়ি, খির ও চিড়া স্বাদ ও ভিটামিনে ভরপুর।
আগের দিনে কৃষকদের বাড়ির বধূদের অনেক কষ্ট করে ধান ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে ভাঙানোর পর চাল ও চিড়া তৈরি করত। ধান ভাঙানোর বৈদ্যুতিক মিল হওয়ায় কৃষকদের বাড়ির বধূদের আর কষ্ট করে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে চাল, আটা ও চিড়া তৈরি করতে লাগে না। এই ঢেঁকি নিয়ে অনেক কবি, সাহিত্যিক যুগে যুগে অনেক কবিতাও লিখেছেন। তাই ঢেঁকির গুণ সম্পর্কে প্রবাদ বাক্য রচনা করেছেন গুণীজনরা, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান বানে।
বর্তমানে গ্রামের দু’একটি কৃষকের বাড়িতে নিজস্ব ভাবে হারিয়ে যাওয়া এই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি দেখা যায়। কিছুদিন পরে গ্রামের কৃষকদের বাড়িতে ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি আর দেখা যাবে না। কালের আবর্তে হারিয়ে যাবে গ্রাম-বাংলার শত বছরের এই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি। এমন এক সময় আসবে যখন আগামী প্রজন্মের কাছে এই ঢেঁকি শুধুই কাল্পনিক জগতের এক কল্পকাহিনির গল্প মনে হবে।
নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার ভারশোঁ গ্রামের ফাতেমা বিবি এই ঢেঁকি সম্পর্কে বলেন, আমাদের বাড়িতে প্রায় ৪০বছর ধরে এই ঢেঁকি ব্যবহার করি আমি। আমি এখনো এই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি ধরে রেখেছি। এখনো ঢেঁকিতে ধান, আটা ও চিড়া ভেঙে আসছি। হাতের কাছে বিভিন্ন যন্ত্র ও প্রযুক্তির ব্যবহার সহজলভ্য হওয়ায় ঢেঁকির মতো ঐতিহ্যবাহী অনেক কিছুই এখন হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় হয়তো প্রাচীন এই যন্ত্রগুলোর দেখা মিলবে কেবল জাদুঘরে।
মোছাঃ পারভিন বলেন, আমাদের পাড়ায় ভারশোঁ ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান সুমন ঢেঁকি দিয়েছে। এই ঢেঁকিতে আমাদের পাড়ার বেশ কয়েকটি পরিবার ব্যবহার করে থাকি।
এ বিষয়ে নওগাঁর মান্দা উপজেলার ভারশোঁ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান সুমন বলেন, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি বর্তমানে বিলুপ্তের পথে। সেজন্য আমি নিজস্ব ভাবে আমার ইউনিয়নের গ্রামে গ্রামে কিছু ঢেঁকি মা-বোনদের দিয়েছি। যাতে করে ঐতিহ্যবাহী এই ঢেঁকি বিলুপ্ত না হয়। আগামী প্রজন্মের কাছে ঢেঁকি যেনো চিরচেনা থাকে সে জন্যই আমার এই প্রচেষ্টা।