মোঃ আতিকুর রহমান, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধিঃ-
গত ১৫ দিন ধরে বহু চেষ্টার পরও শেষ পর্যন্ত রক্ষা করা গেল না সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বর্ধিত গুরমা হাওরের বাঘমারা ফসল রক্ষা বাঁধটির। রবিবার সকাল থেকেই ২৩নাম্বার পিআইসির গাঙ্গের বাধ সংলগ্ন কান্দার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়া শুরু হয়। এরপর বেলা ৪টার দিকে গুরমার হাওর বর্ধিতাংশ উপপ্রকল্পের ২৭ নম্বর ফসল রক্ষা বাঁধ(বাঘমারা বাধ) ভেঙে যায়। এতে তাহিরপুর উপজেলার গলগলিয়া ও পানার হাওরে পানি ঢুকে প্রায় ৩০০ বিঘা জমির বোরোধান তলিয়ে যায়। অপরদিকে গুরমার বর্ধিতাংশ এই বাঁধটি ভেঙে যাওয়ার কারণে পার্শ্ববর্তী মধ্যনগর উপজেলার ছোটবড় কয়েকটি হাওর হুমকির মুখে রয়েছে। উল্লেখযোগ্য বর্ধীত গোরমার অংশে খাউজ্জাউরী, নয়াহাল, গলগলিয়া, ফানা, কাউয়ার খালসহ বেশ কয়েকটি হাওর রয়েছে। এছাড়াও বাধটি ভেঙ্গে যাওয়ায় মধ্যনগর উপজেলার দক্ষিণ বংশীকুন্ডা ইউনিয়নের হানিয়া কলমা, ও শালদিঘাসহ বেশ কয়েকটি হাওর ঝুকিতে রয়েছে। ফলে দুই উপজেলার ছোট বড় মিলিয়েং ১০টি হাওরের প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে যাবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানা যায়, দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের বর্ধিত গুরমার হাওরের ২৭নং পিআইসির ফসলরক্ষা বাঁধে ফাটল দেখা দেওয়ায় বাধটি রক্ষার্থে তাহিরপুর উপজেলা প্রশাসন স্থানীয় কৃষকদেরকে সাথে নিয়ে গত কয়েকদিন যাবৎ কাজ করছিল।
রবিবার দুপুরে সরেজমিনে বাধটিতে গিয়ে দেখা যায়, ভারত থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে এই হাওরটি কানায় কানায় পরিপূর্ণ। কোথাও কোথাও নদীর পাড় উপচে পানি ঢুকছে হাওরে। ২৭ নাম্বার পিআইসির বাঘমারা অংশে যে বাঁধটি দেওয়া হয়েছে, সেটিতে এলাকার গুরমার হাওরের ফসল রক্ষা হওয়ার কথা। তবে বাধটি ভেঙ্গে যাওয়ায় দুই উপজেলার প্রায় দশটি হাওরের ফসল ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে। হাওরের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এই বাঁধটি রক্ষার্থে গত ১৫ দিন যাবৎ নিরলস পরিশ্রম করেছেন প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা। রাত-দিন সেখানে কাজ চলেছে। গত ১৫দিন যাবৎ রাতেও নৌকায়ই অবস্থান করেছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ভেঙে যাওয়া বাঁধটি পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেনসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।
পানার হাওরের কৃষক সাইফুল ইসলাম শেখ(৬৫) জানান, তিনি এ হাওরের ৩ বিঘা জমিতে বোরো ফসল চাষ করেছিলেন ধান লাগিয়েছিলেন। বাঁধটি ভেঙ্গে যাওয়ায় তাঁর সমস্ত জমির আধপাকা ধান তলিয়ে গেছে।
গলগলিয়া হাওরের কৃষক লালসাদ মিয়া জানান, গলগলিয়া হাওরটি আয়তনে ছোট। এখানে সর্বসাকুল্যে আমরা ৫০/৬০ জন কৃষক জমি চাষ করেছিলাম। কিন্তু হাওরের এ ফসল রক্ষা বাঁধটি ভেঙ্গে আমাদের সব ফসল তলিয়ে গেছে।
মধ্যনগর উপজেলার দক্ষিণ বংশিকুন্ডা ইউনিয়নের কৃষক উজ্জল মিয়া জানান, ”তাহিরপুর উপজেলার ২৭ নাম্বার পিআইসির বাধটি মূলত দুটি উপজেলার কয়েকটি হাওরের প্রটেকশন হিসেবে কাজ করে। কিন্তু বাধটি ভেঙ্গে যাওয়ায় আমাদের মধ্যনগর উপজেলার সবগুলো হাওর এখন ঝুঁকিতে রয়েছে, যে কোনো সময় আমাদের হাওরের ফসল পানিতে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”
তাহিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসান উদ দৌলা জানিয়েছেন, বাঁধটি ভেঙ্গে যাওয়ায় হাওরের প্রায় ৩০৯ বিঘা জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। তবে হাওরের পাকা ধান কেটে ফেলায় ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কমেছে। গলগলিয়া ও পানার হাওরের কিছু ধান ইতোমধ্যে কৃষকরা কেটে ফেলেছেন। দুটি হাওরেই ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ চলছিলো।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রায়হান কবীর বলেন, বাঁধটি রক্ষায় আমরা উপজেলা প্রশাসন দিনরাত কাজ করেছি। কিন্তু উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারনে পাটলাই নদীর পানি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় পানির চাপে হঠাৎ করে এ বাঁধটি ভেঙে যায়। আমরা ক্ষতির পরিমাণ ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করব।
অপরদিকে জগন্নাথপুর উপজেলার দুটি ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢুকে পড়েছে। গতকাল সকালে কুশিয়ারা নদীতীরবর্তী রমাপতিপুর গ্রামের গলাখাল বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢুকে পড়ে। এর আগে গত শনিবার রাতে নলজুর নদের পানি উপচে আদাকান্দি হাওরে ঢুকে পড়ে। নিরুপায় হয়ে আতঙ্কিত কৃষকরা নৌকা দিয়ে পানির মধ্যে আধাপাকা ধান কাটছেন।
জগন্নাথপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শওকত ওসমান মজুমদার জানিয়েছেন, আদাকান্দি হাওরে ১২০ হেক্টর জমি আছে। তার মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৫ থেকে ২০ হেক্টর জমির ধান পেকেছে। বাকি ধান এখনো কাঁচা। রমাপতিপুর হাওরে ১০ হেক্টর জমি রয়েছে। এর মধ্যে কিছু ধান কৃষকরা কাটতে পারলেও অধিকাংশ ধান কাঁচা থাকায় কাটা সম্ভব হয়নি। তিনি আরও জানান, পাহাড়ি ঢলের পানির চাপে আদাকান্দি হাওরে পানি ঢুকছে। গত দুদিন এলাকাবাসী অনেক চেষ্টা করেও স্থানীয় কৃষকদের দ্বারা নির্মিত বাঁধটি রক্ষা করতে পারেননি।
এদিকে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে হুরামন্দিরা হাওরের ৪২ নম্বর পিআইসি বাঁধের সাতবিলা রেগুলেটর সংলগ্ন অংশ ভেঙে গেছে। রোববার (১৭ এপ্রিল) সন্ধ্যায় ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় হাওরে পানি ঢোকা শুরু করে। এতে ৩০০ হেক্টর বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, দিরাইয়ে হুরামন্দিরা হাওরে ১০০০ হেক্টর জমি রয়েছে। এখন পর্যন্ত ৭০০ হেক্টরের বোরো ধান কেটেছেন কৃষক। সন্ধ্যায় বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ৩০০ হেক্টর জমির ধান পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, হাওরে জমির পরিমাণ আরও বেশি। কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্য সঠিক নয়। বাঁধ ভাঙার ফলে ৫০০ হেক্টরের বেশি জমি তলিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন তারা।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বললেন, দিরাইয়ে হুরামন্দিরা হাওরে ১০০০ হেক্টর জমি রয়েছে। রোববার পর্যন্ত হাওরের ৭০ ভাগ ধান কেটেছেন কৃষক।
স্থানীয় কৃষক ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার গোড়ারগাঁও ফসলরক্ষা বাঁধ, খাশিলা গ্রামের পাঠার হাওর বেড়িবাঁধ, সনুয়াখাই বেড়িবাঁধ, অদাকান্দি হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ, রমাপতিপুর হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ, নলুয়ার হাওরের ভূরাখালী বেড়িবাঁধ ও হামহামিয়া জলকপাট বাঁধরক্ষায় গত শুক্র ও শনিবার সারা দিনরাত কৃষকরা কাজ করেন। গত শনিবার সকালে পাঠার হাওর বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা দিলে হাওরে পানি ঢুকে পড়ার উপক্রম হয়। খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাজেদুল ইসলাম, সহকারী কমিশনার (ভূমি) অনুপম দাস, পাউবোর মাঠ কর্মকর্তা হাসান গাজী উপস্থিত হয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে বাঁধরক্ষায় কাজ করেন।
সুনামগঞ্জ পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সুরমা নদীর পানির উচ্চতা রবিবার বেলা তিনটায় ছিল ৫ দশমিক ৮৮ মিটার। গত ২৪ ঘণ্টায় এ নদীর পানির উচ্চতা বেড়েছে ৪২ সেন্টিমিটার।
সুনামগঞ্জে এবার প্রথম দফা পাহাড়ি ঢল নামে ৩০ মার্চ। এখন দ্বিতীয় দফা পাহাড়ি ঢলেও ফসল বেশি ঝুঁকিতে আছে এ উপজেলার। উপজেলার সব নদ-নদীর পানি আবার বাড়ছে। এতে মাটিয়ান হাওর, গুরমার হাওর, শনির হাওর, মহালিয়া হাওর, সমসার হাওরের ফসল আবার ঝুঁকিতে পড়েছে। একইভাবে এসব হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধগুলোতেও পানির চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে টাঙ্গুয়ার হাওরের বাঁধগুলো রয়েছে চরম ঝুঁকিতে।