রাহাদ সুমন,বানারীপাড়া(বরিশাল)প্রতিনিধি॥
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকার মহাখালীতে গুলিতে নিহত বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার পূর্ব বেতাল গ্রামের আল-আমিন রনি (২৪) কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছেন। তবে মেয়ের মুখ দেখা ও বাবা ডাক শোনা হলো না তার। আফসোস নিয়েই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। রনির বড়ই স্বাদ ছিল বাবা ডাক শোনার । ঘাতকের বুলেট সেই স্বপ্ন তার চিরতরে কেড়ে নিল। আর বাবার মুখ দেখাও হলো না নবজাতক কন্যার। বাবার আদর-সোহাগ ছাড়াই বেড়ে উঠবে সে। সোমবার (৪ নভেম্বর) সকালে বানারীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজারিয়ান অপারেশেনের (অস্ত্রোপচারের ) মাধ্যমে ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন নিহত রনির স্ত্রী মোসাম্মৎ মিম আক্তার (১৯)। এ বিষয়ে বানারীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. ফকরুল ইসলাম মৃধা বলেন, প্রসূতি তার তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। মা-মেয়ে উভয়ই সুস্থ আছে। তিনি আরও বলেন, শুরু থেকে তিনিসহ হাসপাতালের চিকিৎসকরা মিমকে সার্বক্ষণিক নজরে রেখেছেন। প্রসূতিকে সুস্থ রাখার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পক্ষ থেকে সরকারি যত ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, সব দেওয়া হয়েছে। উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের পূর্ব বেতাল গ্রামের বাসিন্দা প্রয়াত দুলাল হাওলাদের ছেলে আল আমিন রনি (২৪)। আল-আমিন রনি রাজধানীর মহাখালীর মাল্টিব্র্যান্ড ওয়ার্কশপে কাজ করতেন। বাবা দুলাল হাওলাদার মারা গেছেন করোনাকালে। মা মেরিনা বেগম, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মিম ও ছোট ভাই রহিমকে নিয়ে ঢাকার মহাখালী সাততলা বাউন্ডারি বস্তি এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন রনি। রনি নিহত হওয়ার সময় উপজেলার চাখারে বাবার বাড়িতে ছিলেন তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। উপজেলার চাখার সরকারি ফজলুল হক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস রনি বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরতে ঢাকার মহাখালীতে একটি ওয়ার্কশপে কাজ নেন। বাড়তি আয়ের জন্য রাতে একটি খাদ্যপণ্য কোম্পানির ডেলিভারি বয়েরও কাজ করতেন তিনি। মা করতেন গৃহপরিচারিকার কাজ।
রনির আয় দিয়ে চলত চার সদস্যের এই পরিবার। ঘটনার দিন ১৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মায়ের কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে মহাখালীর বস্তি এলাকার বাসা থেকে বের হন রনি। বিকেল ৫টার দিকে মহাখালী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। রাত ৮টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে তাঁর মরদেহ শনাক্ত করেন মা মেরিনা বেগম। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ ২০ জুলাই বানারীপাড়ার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের পূর্ব বেতাল গ্রামে আনা হয়। ওই দিন দিবাগত রাত ১টায় পারিবারিক কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে তার মরদেহ দাফন করা হয়।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য,রনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তিনি পরিবারের একমাত্র রোজগেরে ব্যক্তি। তাঁর আয়েই চলত সংসার। মাস শেষে কষ্টার্জিত উপার্জনের টাকা তিনি মায়ের হাতে তুলে দিতেন। গ্রামের বাড়ি থাকা দাদিও তাঁর ভরণ-পোষণে রনির ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। রনি নিহত হওয়ার সময় তার স্ত্রী মিম ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। আদরের নাতিকে হারিয়ে আজও কান্না থামছে না রনির দাদি শতবর্ষী মরিয়ম বেগম ও নাড়ী ছেড়া বুকের ধন ছেলে হারানো মা মেরিনা বেগমের। শোকে স্তব্ধ স্ত্রী মিমের চোখেও উৎকন্ঠার অমানিশার ঘোর অন্ধকার পিতৃহীন নবজাতক কন্যা ও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে। রনির মা মেরিনা বেগম কান্নাভেজা কন্ঠে বলেন, আজ রনি বেঁেচ থাকলে মেয়ের মুখ দেখে কতইনা খুশি হতেন। সন্তানের মুখ দেখা ও বাবা ডাক শোনার খুবই ইচ্ছে ছিল আমার বাপজানের। রনির শ্বশুর ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ী মো. কামাল হোসেন মাঝি বলেন, তার মেয়ে মিম এইচএসসি পাস করেছেন। মেয়েকে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন তিনি।