আবারও বাড়তে শুরু করেছে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু। চব্বিশ ঘণ্টায় আরও ৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ৪৫ দিনের মধ্যে এটিই সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা। তাদের মধ্যে খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে মোট ১৩ হাজার ৩৪৫ জন মারা গেলেন। একই সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টায় নতুন করে আরও তিন হাজার ৮৪০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা আট লাখ ৪১ হাজার ৮৭ জনে পৌঁছাল।
অন্যদিকে, এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর শনাক্ত-মৃত্যু কমে আসছিল। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ-মৃত্যু আবার বাড়তে শুরু করে। গত তিন সপ্তাহে শনাক্তের হার ৭ থেকে ১৭ শতাংশে পৌঁছেছে। ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী ২১ জেলায় সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ওই জেলাগুলোয় গত এক সপ্তাহে শনাক্তের হার ২১ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। এর বাইরে আরও ২৯টি জেলায় সংক্রমণ বাড়ছে। এসব জেলায় শনাক্তের হার ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। কয়েক দিন ধরে রাজধানী ঢাকায়ও শনাক্তের হার বাড়তে শুরু করেছে। এক সপ্তাহে শনাক্তের হার সাড়ে ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ঢাকার আশপাশের কয়েকটি জেলায়ও সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে, বিশেষ করে টাঙ্গাইলে শনাক্তের হার ৪০ শতাংশে পৌঁছেছে।
সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনা করে জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশ করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের দ্বারপ্রান্তে। গত মার্চ-এপ্রিলের চেয়েও এটি ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে তারা বলেন, সংক্রমণ বাড়লে তা সামাল দেওয়া স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষে কঠিন হতে পারে। সুতরাং এখনই স্বাস্থ্য বিভাগের জোরালো প্রস্তুতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা সংস্থা (আইসিডিডিআর,বি) তাদের এক গবেষণার তথ্য দিয়ে বলেছে, করোনায় আক্রান্ত ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে ৬৮ শতাংশই ভারতীয় ধরনে (ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট) সংক্রমিত।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ কমো মডেলিং গ্রুপের আওতায় একদল জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ করোনা সংক্রমণের পূর্বাভাস নিয়ে কাজ করছে। এই দলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং বিদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রয়েছেন। তারা দেশে করোনা সংক্রমণের পূর্বাভাস নিয়ে একটি সম্ভাব্য চিত্র এঁকেছেন। গাণিতিক মডেল বিশ্নেষণ করে তারা যে পূর্বাভাস দিয়েছেন, সে অনুযায়ী আগামী জুলাই মাসে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আরেকটি পিক বা সর্বোচ্চ চূড়ায় যেতে পারে। এ সময় প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার শনাক্ত এবং ১০০ জনের মৃত্যু হতে পারে।
গবেষক দলের সদস্য ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন সমকালকে বলেন, গত ঈদে মানুষের চলাচল এবং ভারতীয় নতুন ধরন ‘ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট’ শনাক্ত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে একটি পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। ৩০ মার্চ সেটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, জুন মাসেই শনাক্ত-মৃত্যু বাড়ছে। এ অবস্থায় আগেরটি থাকবে নাকি নতুন করে পর্যালোচনা করা হবে, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুতই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর চলতি বছরের ৩০ মার্চ আক্রান্তের সংখ্যা ছয় লাখ ছাড়ায়। পরের ২০ দিনেই আক্রান্ত হয়েছে আরও এক লাখ ২৩ হাজারের বেশি মানুষ। গত বছরের জুন-জুলাই মাসে সংক্রমণ পিক বা চূড়ায় পৌঁছেছিল। ওই দুই মাসে প্রায় দুই লাখের মতো মানুষ আক্রান্ত এবং প্রায় আড়াই হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এরপর ধাপে ধাপে সংক্রমণ কমতে থাকে। চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে শনাক্তের হার কমে প্রায় আড়াই থেকে দুই শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছায়। কিন্তু মার্চ থেকে সংক্রমণ ও মৃত্যু আবারও বাড়তে থাকে। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত সংক্রমণ পিক বা চূড়ায় পৌঁছায়। এপ্রিল মাসেই প্রায় দেড় লাখ আক্রান্ত এবং মৃত্যু হয় প্রায় আড়াই হাজার মানুষের। গত বছরের পিকের দ্বিগুণ হারে আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়। এরপর লকডাউনের কারণে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ কমতে থাকে। মে মাসে শনাক্তের হার কমে ৭ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছায়। কিন্তু মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শনাক্তের হার আবারও বাড়তে থাকে। গত তিন সপ্তাহ শনাক্তের হার বাড়তে বাড়তে তা ১৭ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে। বাড়ছে মৃত্যুও। ২ জুন শনাক্তের হার ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। ১৬ জুন তা ১৬ দশমিক ৬২ শতাংশে পৌঁছেছে। তবে গত চব্বিশ ঘণ্টায় শনাক্তের হার কিছুটা কমে ১৫ দশমিক ৪৪ শতাংশে নেমেছে।
করোনা সংক্রমণের পর থেকে রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনা করে আসছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এক সপ্তাহ ধরে রোগটির কোন সূচকে কী পরিবর্তন হয়, তা তাদের পর্যালোচনায় উঠে আসে। নমুনা পরীক্ষা, শনাক্ত, সুস্থতা ও মৃত্যু- এ চারটি সূচক ধরে এই রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনা করা হয়। আগের সপ্তাহের তুলনায় পরবর্তী সপ্তাহে এই চার সূচকের কোনটিতে কী পরিবর্তন হলো, তা নিয়ে পর্যালোচনা প্রকাশ করা হয়। চলতি মাসে এ পর্যন্ত দুটি পর্যালোচনা হয়েছে। ৫ জুনের পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২১তম সপ্তাহের তুলনায় ২২তম সপ্তাহে শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ৪৮ এবং মৃত্যু ২৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেড়েছে।
সর্বশেষ ১২ জুনের রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২২তম সপ্তাহের সাপেক্ষে ২৩তম সপ্তাহে শনাক্তের হার ২৭ দশমিক ২০ এবং মৃত্যু ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর এ চিত্র পর্যালোচনা করলে বলা যায়, তৃতীয় ঢেউয়ের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ।
জোরালো প্রস্তুতির আহ্বান বিশেষজ্ঞদের :তৃতীয় ঢেউ আসছে ধরে নিয়ে এখন থেকেই স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষকে জোরালো প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি সমকালকে বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকলে এবং সেটি ১০ শতাংশের ওপরে গেলে ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু বাংলাদেশে চার সপ্তাহের কাছাকাছি সময় ধরে সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। ধীরে ধীরে তা বাড়ছে। গত বছর ঢাকা থেকে সংক্রমণ শুরু হয়ে সারাদেশে ছড়িয়েছিল। এবার ভারতের সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে সংক্রমণ শুরু হয়েছে এবং সেটি ধাপে ধাপে অন্যান্য জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। ভারতীয় নতুন ধরনে অধিকাংশ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বলে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে শনাক্ত হয়েছে। সুতরাং ভারতের পরিস্থিতির আলোকে সংক্রমণের এই চাপ সামলাতে জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের মজুদ, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা এবং হাসপাতালগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপন করা দরকার। অন্যথায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।