৫বছর পূর্ণ হলেও পরিবর্তন হয়নি এখনো, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো আজও বাস করছেন পাহাড়ের গায়ে
রাঙ্গামাটি সংবাদদাতাঃ
রাঙ্গামাটির ভয়াবহ পাহাড় ধসের মর্মান্তিক ঘটনার ৫ বছর পূর্ণ হবে আগামীকাল। ২০১৭ সালের ১৩ জুনের রাতে টানা তিনদিনের ভারী বৃষ্টি আর বজ্রপাতে রাঙ্গামাটিতে ঘটে যায় স্মরণকালের পাহাড় ধসের ঘটনা। বছর ঘুরে দিনটি ফিরে এলে রাঙ্গামাটিবাসীর মনে দেখা দেয় আতঙ্কের সেই ভয়াল স্মৃতি।
পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে একদিনেই প্রাণ হারিয়ে ছিলেন, সেনা সদস্যসহ নারী পুরুষ ও শিশুসহ ১২০ জন। এর মধ্যে শহরের মানিকছড়িতে একটি সেনা ক্যাম্পের নিচে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম প্রধান সড়কের উপর ধসে পড়া মাটি অপসারণ করতে গিয়ে পুনরায় পাহাড় ধসের মাটি চাপা পড়ে নিহত হন ঐ ক্যাম্পের দুই কর্মকর্তাসহ ৫ সেনা সদস্য।
নিহত সেনা সদস্যরা হলেনÑমেজর মোহাম্মদ মাহফুজুল হক, ক্যাপ্টেন মো. তানভীর সালাম শান্ত, করপোরাল মোহাম্মদ আজিজুল হক, সৈনিক মো. শাহিন আলম, ও সৈনিক মো. আজিজুর রহমান।
জেলা প্রশাসনের হিসাবে রাঙ্গামাটি সদরে ৬৬ জন, জুরাছড়ি উপজেলায় ৬জন, বিলাইছড়ি উপজেলায় ২জন, কাপ্তাই উপজেলায় ১৮জন এবং কাউখালী উপজেলায় ২১ জন মিলে মোট ১১৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে শিশু-৩৩, মহিলা-৩২, পুরুষ ৪৮ জনের মরদেহ পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে অন্য যে কোন পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালের ১৩ জুনের পাহাড় ধসের ঘটনা সেরকম ছিলনা। রাঙ্গামাটি ব্যাপক প্রানহানীর সাথে ব্যাপক ভৌত অবকাঠামো ভীষনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাহাড়ে ঘরবাড়ী আছে এমন পাহাড়ও যেমন ভেঙ্গেছে, তেমনী ঘরবাড়ী ছিলনা এমন অসংখ্য পাহাড়ও ভেঙ্গে পড়ে। আবার ঝোপ জঙ্গল গাছপালাতে ভরপুর এমন পাহাড়ও ভেঙ্গে পড়ে। এক কথায় সব রকম পাহাড়েই মাটি ধস ধসে পড়ে। এটার ব্যাপ্তি, বিস্তৃতিও গভীরতা অনেক বেশী ছিল।
টানা তিনদিনের প্রবল বর্ষনে পাহাড় ধসে রাঙ্গামাটির এত লোকের প্রাণহানি, ঘরবাড়ি, সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুতের এতবড় ক্ষতি হবে সেদিন কেউ ভাবতে পারেনি। সেদিন মুহূর্তেই সব দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল পর্যটন শহর রাঙ্গামাটি।
১৩ জুন রাত থেকেই শুরু হয়েছিল প্রচন্ড গগনবিদারী আওয়াজে বজ্রপাতসহ ভারি বৃষ্টি। ভয়ে আতংকে সেই রাত কাটাতে হয়েছিলো রাঙ্গামাটির মানুষকে। ভোর হওয়ার পর রাঙ্গামাটি শহরের ভেদভেদী, মোনতলা, রাঙ্গাপানি, শিমুলতলি, মুসলিম পাড়া ও লোকনাথ মন্দির এলাকা, সদর উপজেলার মগবান ও সাপছড়ি ইউনিয়নসহ ৫টি উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির খবর আসতে থাকে। সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল ১৩ জুন রাঙ্গামাটিতে। আর কোন দুর্যোগে রাঙ্গামাটিতে এতো প্রাণহানী ঘটেনি।
পাহাড় ধসে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কের শালবন এলাকায় ১০০ মিটার রাস্তা ধসে গিয়ে একেবারে বিলীন হয়ে যায়। দেশের অন্যান্য স্থানের সাথে রাঙ্গামাটি ৯দিন সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। বিভিন্ন আন্ত সড়কে ১৪৫টি স্থানে সড়কে ভাঙ্গন দেখা দেয়। পাহাড় ধ্বসের বিপর্যয়ে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক ছাড়াও রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি-বান্দরবান সড়ক, রাঙ্গামাটি-বড়ইছড়ি ও রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিছিন্ন হয়ে যায়।
এছাড়া রাঙ্গামাটির বৈদ্যুতিক গ্রীড লাইনের পোল ও লাইনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফলে রাঙ্গামাটি শহরের ৩ দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে। আর বিশুদ্ধ পানির জন্য শহরের হাহাকার পড়ে যায়। সেনাবাহিনী ও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীদের দ্রুত প্রচেষ্টায় তিন দিনের মাথায় বিদ্যুৎ ও দশ দিনের মধ্যে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রামে সড়ক যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করা সম্ভব হয়। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় কাপ্তাই-রাঙ্গামাটি নৌ পথে লঞ্চ দিয়ে পানি, জ্বালানী তেল ও পন্য পরিবহনসহ লোকজনের চলাচলের ব্যবস্থা গ্রহন করে প্রশাসন।
গৃহ হারা হয়ে রাঙ্গামাটির ১২টি আশ্রয় কেন্দ্রে ২ হাজারের বেশী মানুষ আশ্রয় নেয়। সেনাবাহিনী আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে পানি ও খাবার সরবরাহ করে।
২০২২ সাল আসলেও রাঙ্গামাটির ভয়াল পাহাড় ধ্বসের ঘটনার ৫ বছর পার হলেও এখনো অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। এতো মৃত্যুর মিছিল ও বিপুল পরিমানের সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির পরও লোকজন আজো পাহাড়ের পাদদেশে ঝুকিপুর্ণ অবস্থায় বসবাস করছেন। গেল পাঁচ বছরে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপুর্ণ অবস্থায় বসবাসকারীদের সংখ্যাও বেড়ে গেছে।
আর প্রতি বছরের ন্যায় বর্ষার শুরুতেই এবারো জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহরে ও উপজেলগুলোতে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষদের বৃষ্টির সময় নিরাপদে সড়ে যেতে ও আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য ব্যাপক প্রচারণা ও সচেতনতা চালিয়ে যাচ্ছেন। শহরের বেশকিছু স্থানে পাহাড়ের পাদদেশে আবারো অসংখ্য বাড়ি-ঘর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তবে পাহাড়ের নীচে বসবাসকারীরা এখনো কেউই সড়ে যাওয়ার সেই প্রস্তুতি নেয়নি। বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার অনিহা প্রকাশ করছেন বার বার।
দিনটির কথা স্মরণ করে এ বছরও রাঙ্গামাটি জেলায় প্রাণহানি এড়াতে আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসক। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে। শহরের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পরিদর্শন করেছেন রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। এসময় তিনি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় যারা পাহাড়ের পাদদেশে যারা বসবাস করছেন তাদের বৃষ্টির সময় নিরাপদে সড়ে যেতে ও আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য নিদের্শ প্রদান করেছেন।
এসময় রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, প্রতি বছরের ন্যায় রাঙ্গামাটি জেলায় পাহাড় ধ্বসের ঘটনায় যাতে প্রাণহানি না ঘটে তার জন্য আগাম সকল ধরনের প্রস্তুতি গ্রহন করেছি। আর এইসব ব্যাপারে প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে দূযোর্গ প্রস্তুতি সভাও করা হয়েছে। সেখানে সকলের সম্মেলিত ভাবে দূর্যোগ মোকাবেলায় সকল ধরনের প্রস্তুতি গ্রহনের নিদের্শনা প্রদান করা হয়েছে এবং প্রতিটি এলাকায় আশ্রয় কেন্দ্র ঘোলা রাখা হয়েছে।
২০১৭ সালের ১৩ জুনের পাহাড় ধস রাঙ্গামাটির ভূ-পৃষ্টতলকে (সারফেস) নাড়িয়ে দিয়ে অত্যন্ত নাজুক করেছে যা গত ৫ বছরেও কাটিয়ে উঠা যায়নি। যে কারণে রাঙ্গামাটির অনেক সরকারী বেসরকারী স্থাপনা, মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্তা দোকানপাটসহ সবকিছু অনিরাপদ করে দেয়। রাঙ্গামাটিতে দৃশ্য ও অদৃশ্য অনেক বেশি ক্ষতি করে দিয়ে যায় সেই স্মরণ কালের পাহাড় ধসের এই ঘটনা। যা রাঙ্গামাটিবাসী কোন দিন ভুলতে পারবেনা এই স্মরণকালের ভয়াবহ এই স্মৃতি ও হারানো বেদনা। তাই বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ের নীচে ঝুঁকিপূর্ন স্থানে বাড়ী ঘর নির্মাণে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলে পাহাড় ধসের প্রাণহানী রোধ করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।