জহুরুল ইসলাম হালিম, রাজবাড়ীঃ
পাট চাষের শুরুতে অতিরিক্ত বৃষ্টি, পোকার আক্রমণ, শ্রমিক সংকটে শ্রম মূল্য বৃদ্ধি, জমিতে সেচ ও পঁচানোর পানি না থাকাসহ নানা প্রতিকুলতার মোকাবেলা করে সোনালী আঁশ পাটের উৎপাদন ভান্ডার খ্যাত রাজবাড়ীতে পাট চাষিরা নতুন পাট ঘরে তুলছেন। বাজারে পাটের দাম ভালো পাওয়ায় পাট চাষিদের মুখে হাসি ফিরে এসেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৮ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হলেও এবার রাজবাড়ীতে পাটের চাষ হয়েছে ৪৯ হাজার ৮শ ২২ হেক্টর জমিতে। যা গত বারের তুলনায় ৮শ ২ হেক্টর বেশী। এছাড়া এবার পাট উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ৫লাখ ৮০হাজার ২শ বেল হলেও এখন পর্যন্ত পাটের উৎপাদন হয়েছে ৬লাখ ২০ হাজার ২২ বেল। যা গত বারের তুলনায় ৩৯ হাজার ৮শ ২২ বেল বেশী। আসা করছেন উৎপাদন আরও বাড়বে। তবে প্রতিকুল আবহাওয়া ও শ্রম মূল্য বৃদ্ধিতে পাট চাষে খরচ বেড়ে যাওয়ায় চাষিরা লাভ নিয়ে চিন্তিত থাকলেও শেষ পর্যন্ত বাজারে পাটের দাম ভালো পাওয়ায় তারা লাভের মূখ দেখেছেন।
রাজবাড়ী সদর উপজেলাসহ গোয়ালন্দ, পাংশা, বালিয়াকান্দি ও কালুখালী উপজেলার বেশ কয়েকজন পাট চাষির সাথে কথা বলে জানা যায়, এবার পাটের চাষ করতে গিয়ে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা। পাট চাষের শুরুতে অতিরিক্ত বৃষ্টি ও পোকার আক্রমণে পাটের চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাট কাটার সময়ে খড়া পরিস্থিতির কারণে খাল-বিল, ডোবা-নালায় পানি না থাকায় ২/৩ কিলোমিটার দুরে নিয়ে পাট জাগ দিতে হয়েছে। এ কারণে প্রতিবিঘা জমিতে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ গুনতে হয়েছে। এছাড়াও এবার পাট চাষের পুরো মৌসুম জুড়ে বেশী মজুরিতে শ্রমিক খাটাতে হয়েছে। গত বছর ৬শ থেকে ৭শ টাকায় শ্রমিক পাওয়া গেলেও এবার তা বেড়ে ৮শ থেকে ১হাজার টাকা পর্যন্ত হয়েছে। এছাড়াও বীজ, কীটনাশক, সারসহ চাষের অন্যান্য খরচও বেড়েছে। ফলে জাগ দেয়া, ছাড়ানোসহ সব মিলিয়ে বিঘা প্রতি জমিতে প্রায় ৪/৫ হাজার টাকা খরচ বেশী হয়েছে। পাটের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলেও বাজারে পাটের মান ভেদে মণ প্রতি ৮শ থেকে ১হাজার টাকা লাভ হওয়ায় খুশি চাষিরা।
কালুখালী উপজেলার বেলগাছী এলাকার পাট চাষি শিপন সরদার বলেন, পাট চাষের শুরু থেকেই অতিরিক্ত বৃষ্টি, পোকার আক্রমণ, খড়া, শ্রমিক সংকটসহ নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়ে পাটে লাভের আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু এবার ৪বিঘা জমিতে পাট চাষ করে আমার ২৬ মণ পাট উৎপাদন হয়েছে, এর মধ্যে প্রথমদিকে ১৮মণ পাট, মণ প্রতি ৩১শ টাকা দরে মোট ৫৫হাজার ৮শ টাকা বিক্রি করেছি। দ্বিতীয় বারে ৮মণ পাট, মণ প্রতি ২৭শ টাকা দরে মোট ২১হাজার ৬শ টাকায় বিক্রি করেছি। মোট পাট বিক্রি করেছি ৭৭হাজার ৪শ টাকা। সব মিলিয়ে পাট উৎপাদনে খরচ হয়েছে ৫৬হাজার ৮শ টাকা অর্থাৎ বিঘাপ্রতি ১৪হাজার ২শ টাকা। এভাবে পাটের ভালো দাম পেলে আমাদের এলাকার চাষিরা পাট চাষে আরো আগ্রহী হয়ে উঠবে।
রাজবাড়ী সদর উপজেলার শহীদ ওয়াহাবপুর ইউনিয়নের বড় নুরপুর গ্রামের পাট চাষি আ. কাদের প্রামানিক বলেন, এবার সোয়া দুই বিঘা জমিতে পাটের চাষ করেছি, শুরু থেকে নানা সমস্যার সম্মুখিন হয়েছিলাম, সবচেয়ে বেশী সমস্যা হয়েছিলো পাট কাটা ও জাগ দেয়া নিয়ে, পাট কাটায় শ্রমিক নিতে হয়েছিলো ৭শ থেকে ৮শ টাকা দিয়ে, পাট ছাড়াতে শ্রমিক মজুরি দিতে হয়েছে জনপ্রতি ১হাজার টাকা করে। এবং খড়ার কারণে ডোবা-নালায় পানি না থাকায় জমি থেকে প্রায় ৩কিলোমিটার দুরে নিয়ে পাট জাগ দিতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক পরিবহন খরচ হয়েছে। যাই হোক সর্বশেষ পাটের দাম ভালো পাওয়ায় সব কষ্ট ভুলে এখন ভালোই লাগছে।
সদর উপজেলার ধুলদি জয়পুর গ্রামের একটি ডোবায় সেখানেই চলছে দলবেঁধে শেষ সময়ের জাগ দেয়া পাট থেকে আঁশ ছাড়ানোর কাজ । এসম কথা হয় পাট চাষি মোহন শেখের সাথে তিনি বলেন, এবার সোয়া ৩ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি। জমি থেকে প্রায় ২কিলোমিটার দুরে এখানে এনে পাট জাগ দিয়েছি। এ কারণে পাট চাষে এবার খরচ হয়েছে বেশী। তবে পাটের ফলন ও রং ভালো হওয়ায় বাজারের সব পাটের থেকে দাম একটু বেশী পেয়ে আনন্দই লাগছে। শেষ পর্যন্ত পাটের এমন দাম পেলে এ এলাকার পাট চাষিরা লাভবান হবে এবং তারা পাট চাষে আরও আগ্রহী হয়ে উঠবে।
খানখানাপুর বাজার কাদরিয়া ট্রেডার্স বানিজ্যালয়ের পাট ব্যবসায়ী মো. ফজলু মোল্লা বলেন, এবার এ অঞ্চলে ব্যাপক পাট চাষ হয়েছে। গতবারের তুলনায় এবার পাটের মানও ভাল। ফলে কৃষকরা দামও ভালই পাচ্ছে। এমন দামে পাট চাষিরা বাজারে পাট বিক্রি করে খুশি মনেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে রাজবাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এস এম সহীদ নূর আকবর বলেন, প্রতিকুল আবহাওয়া ও শ্রমিক সংকটের কারণে এবার পাট আবাদের ক্ষেত্রে খরচ বেশী হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত বাজারে পাটের দাম ভালো পাওয়ায় চাষিরা লাভের মুখ দেখেছেণ। এছাড়া পলিমাটি, জৈব সারের ব্যবহার ও বন্যার পানি প্রবেশ না করায় এবার জেলায় পাটের আবাদ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে। আর অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই পাট কাটা শেষ হবে। এবার পাটের ফলনও ভালো দামও ভালো পাওয়ায় খুশি চাষিরা।