নওগাঁ সংবাদদাতাঃ
অনাবৃষ্টিতে নদী-নালা ও ডোবায় পানি না থাকায় পাট জাগ দেওয়া যাচ্ছে না। পাট চাষে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং পানি সংকটে জাগ দেওয়ার সমস্যার কারণে প্রতিবছর নওগাঁয় কমছে পাটের আবাদ। তবে কৃষি বিভাগ বলছে কৃষকদের আগ্রহ বাড়াতে প্রণোদনাসহ সার্বিক সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলায় ৫ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে পাটের আবাদ হয়েছিল ৫ হাজার ৭২৫ হেক্টর। ২০২০-২১ অর্থ বছরে পাটের আবাদ হয়েছিল ৫ হাজার ৯৩৩ হেক্টর। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬ হাজর ১৫০ হেক্টর এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়। গত ৫ বছরের ব্যবধানে পাটের আবাদ কমেছে ১ হাজার ৬০০ হেক্টর।
জানা গেছে, এক বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করতে খরচ পড়ে ১০ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকা। এরমধ্যে জমির আইল ঠিক করা ৪০০ টাকা, পানি সেচ ১ হাজার টাকা, হালচাষ তিনটা ১ হাজার টাকা, সার ১২০০ টাকা, বীজ দেড়কেজি ৪০০ টাকা, কীটনাশক ও শ্রমিক খরচ ৫০০ টাকা, পোকা দমনে কীটনাশক খরচ ৭০০ টাকা। ঘাস নিড়ানিতে ৫-৬ জন শ্রমিকের খরচ ১৫০০-১৮০০ টাকা। এরপর পাট কাটতে ৫-৬ জন শ্রমিকের খরচ হিসেবে ২৫০০-৩০০০ টাকা, পরিবহন খরচ ১৫০০ টাকা এবং জাগ দেওয়া ১৫০০ টাকা। সবশেষে ৬-৭ জন শ্রমিকের পাট পরিষ্কারে খরচ পড়ে ৩০০০-৩৫০০ টাকা।
জেলায় এ বছর দেশি, তোষা এবং মেস্তা জাতের পাট চাষ হয়েছে। দেশি জাতের মধ্যে সিভিএল-১ ও ডি ১৫৪ জাত। তোষা জাতের মধ্যে ও-৪ এবং ৭২। উপজেলা ভিত্তিক পাট চাষ হয়েছে সদর উপজেলায় ৬০০ হেক্টর, রানীনগরে ৪০ হেক্টর, আত্রাইয়ে ২৫০ হেক্টর, বদলগাছীতে ১ হাজার ৪৬০ হেক্টর, মহাদেবপুরে ২০০ হেক্টর, পত্মীতলায় ১৫০ হেক্টর, ধামইরহাটে ৮৩০ হেক্টর এবং মান্দায় ১ হাজার ৮০০ হেক্টর। জেলার ১১টি উপজেলার মধ্যে সাপাহার, পোরশা ও নিয়ামতপুর উপজেলায় এ বছর কোনো পাট চাষ হয়নি বলে জানায় কৃষি অফিস।
একসময় পাটকে বলা হতো সোনালি আঁশ। তবে পাটের সে সোনালি ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। পানি সংকটে জাগ দেওয়া সমস্যা, শ্রমিক সংকট ও মজুরি বেশি হওয়ায় এবং দাম না পাওয়ায় পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন চাষিরা। তবে উঁচু জমি ফেলে না রেখে বা অন্য ফসল না হওয়ায় বাধ্য হয়ে চাষিরা পাটের আবাদ করছেন।
অপরদিকে পাটের আবাদ কমে যাওয়ায় গত দু’বছর থেকে বেড়েছে পাটের দাম। এক বিঘাতে ৮-১২ মণ পাটের ফলন হয়। প্রতিমণ পাট গত বছর ২৪০০-৩০০০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন বলে জানান চাষিরা।
সদর উপজেলার পানিশাইল গ্রামের পাটচাষি আনিছুর রহমান বলেন, বিগত বছরগুলোতে ৩ বিঘা জমিতে ভেলি (দেশি) জাতের পাটের আবাদ করতাম। পানি সংকটে পাট জাগ দেওয়ার সমস্যায় এ বছর ১ বিঘাতে আবাদ করেছি। এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় পাটচাষিদের জন্য বেশি সমস্যায় পড়তে হয়েছে। প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ট্রাক্টর দিয়ে পাট নিয়ে গিয়ে জাগ দিতে হবে। পরিবহন খরচ পড়বে দেড় হাজার টাকা। পাট কাটতে খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা এবং ধোয়ার সময় খরচ হবে আরো ৪ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, পাট চাষে শ্রমিকের মজুরি ও উৎপাদন খরচ বেড়েছে। আবার দাম না পেলে লোকসান গুনতে হয়।
পানি সংকটে পাটচাষ কমছে নওগাঁয়
একই গ্রামের দুলাল হোসেন বলেন, দেড় বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করেছি। পাটের জমিতে ধান ভালো হয়। পাটের পাতা জমিতে পড়ে উর্বরতা বাড়ে। এতে করে সারের খরচও কম হয়। এ জমিতে বছরে তিনটা ফসল হয়। ধান, পাট, পেঁয়াজ, রসুন, আলু ও ক্ষীরা। পাটের আবাদ করে লাভ না হলেও লোকসান হয় না। পাটকাঠিও কাজে লাগে।
মান্দা উপজেলার মোল্লাপাড়া গ্রামের পাটচাষি আব্দুস সালাম বলেন, দু’বছর থেকে আবারও সরকার পাটের দাম দিচ্ছে। এবছর ২ বিঘা জমিতে দেশীয় জাতের পাট চাষ করেছি। পাটচাষের বড় সমস্যা জাগ দেওয়া। অনাবৃষ্টিতে নদী-নালা ও ডোবায় পানি না থাকায় জাগ দেওয়া যাচ্ছে না।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) একেএম মনজুরে মাওলা বলেন, পাটচাষে চলতি অর্থ বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ৪২৫ হেক্টর কম অর্জিত হয়েছে। পানি সংকটে পাট জাগ দেওয়া (পঁচানো) সমস্যার কারণে কৃষকরা নিরুৎসাহীত হওয়ায় কম পরিমাণে আবাদ হয়েছে। বাজারে বর্তমানে পাটের দাম ভালো হওয়ায় কৃষকরা আগ্রহী হচ্ছেন।
পাটচাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রণোদনাসহ কৃষি বিভাগ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে। পানি সংকট নিরসনে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পুকুর খনন বা নদী ড্রেজিং (খনন) করে পানি ধরে রাখা যেতে পারে। এতে করে কৃষকরা পাট জাগ দেওয়া সমস্যা থেকে রক্ষা পাবেন।