অনলাইন ডেস্কঃ
বিশ্ব অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি নতুন চাপ তৈরি করেছে। করোনা-পরবর্তী এই সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সরবরাহ ব্যবস্থায় যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, তার প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতেও। নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি দেওয়ার যে চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, তা সামলে নতুন অর্থবছরে অর্থনীতিকে উত্থানের ধারায় কতটা এগিয়ে নেবে, সেই প্রশ্ন এখন সামনে। আমদানি করা মূল্যস্ফীতির চাপ আর করোনায় কর্ম হারানোদের আয়ের সংস্থান—দুটিই নতুন বছরের বাজেটে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
২০২৩ সালের জুনে এই বাজেট-বর্ষ শেষ হলেও আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে এটিই বর্তমান মেয়াদে সরকারের বাস্তবায়নের জন্য পূর্ণাঙ্গ বাজেট। একই সঙ্গে এটি অগ্রাধিকারমূলক উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখতে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তাসহ নানামাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার বাজেট। খোদ অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন তার সামনে ছয়টি চ্যালেঞ্জের কথা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি ছাড়াও চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে—জ্বালানি খাতের মূল্যবৃদ্ধিজনিত ভর্তুকির অর্থসংস্থান, নির্ধারিত সময়ে বৈদেশিক অর্থ ব্যবহার ও প্রকল্প শেষ করা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রকল্প বাস্তবায়ন, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করা। অর্থমন্ত্রীর তালিকায় সর্বশেষ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী কিছুটা কৌশলী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। চাহিদার লাগাম টেনে ধরে সরবরাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তা তার। একই সঙ্গে তার বাসনা চ্যালেঞ্জকে সুযোগে পরিণত করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চ্যালেঞ্জকে সুযোগে পরিণত করে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তিনি তার বাজেট বক্তৃতায়। তাই নতুন অর্থবছরকেই তিনি বলেছেন অতিমারির প্রভাব কাটিয়ে ওঠার শেষ বছর। কিন্তু কীভাবে?
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আশাবাদী তথা দৃঢ়তার কথা বাজেট বক্তৃতায় স্পষ্ট হলেও মূলত তা নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল ও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় পরিস্থিতির ওপর। যে কারণে বাজেটে তার নেওয়া পদক্ষেপগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় থাকা স্বাভাবিক। একদিকে বিশ্ব পরিস্থিতি এখনো চরম অনিশ্চয়তায়, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা না হলে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে অর্থনীতি সংকুচিত হওয়াই স্বাভাবিক। তাতে প্রত্যাশিত মাত্রায় রাজস্ব আয় হবে না। কিছু ক্ষেত্রে ঢালাও ভ্যাট-ট্যাক্স অব্যাহতি, আবার কোথাও কঠোর—দুটিই প্রত্যাশায় ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়।
কর্মসংস্থান ও ক্রয়ক্ষমতা না বাড়ালে পণ্যমূল্যের এই বাজারে সাধারণের জীবনে স্বস্তি আসবে না। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্ব থাকলেও ঘাটতি অর্থায়ন মেটাতে ব্যাংকব্যবস্হা থেকে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিতে হবে সরকারকে। তাতে বেসরকারি বিনিয়োগ নিরুত্সাহিত হবে।
ব্যক্তির সর্বনিম্ন করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ টাকায় অপরিবর্তিত রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। পণ্যমূল্যের অস্বাভাবিকতায় জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় এই সীমা ৫ লাখ টাকায় উন্নীত করার দাবি ছিল বিভিন্ন মহলের। তা হয়নি। উপরন্তু, ভ্যাটের দাপটে (আওতা বাড়ানোর ফলে) অনেক পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে চাহিদার লাগাম টেনে ধরার যে কৌশল তিনি গ্রহণ করেছেন, তা কার্যকর না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থার মধ্যে সামঞ্জস্য নিশ্চিত করতে না পারলে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে।
সাধারণের কথা চিন্তা করে যদিও অর্থমন্ত্রী কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছেন, তার মধ্যে রয়েছে ৫০ লাখ পরিবারকে ১৫ টাকা কেজিতে চাল দেওয়া, ২ লাখ ৯ হাজার নারী ও শিশুকে নতুন করে ভাতার আওতায় আনা, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার না কমানো ইত্যাদি। ধারাবাহিকভাবেই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়িয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সবার জন্য পেনশন কর্মসূচির ঘোষণাও রয়েছে বাজেট বক্তৃতায়। কৃষি খাতের আমূল পরিবর্তনে নতুন বাজেটে ৩৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন।
নতুন বছরের বাজেটে করপোরেট কর হারে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন, পাচারকৃত টাকা ফেরত আনার উদ্যোগের ঘোষণা রয়েছে। পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরত আনলে ৭ শতাংশ হারে কর দিয়ে তা প্রদর্শন করা যাবে। কেউ চাইলে বিদেশে থাকা সম্পদেরও ঘোষণা দিতে পারবে। সেক্ষেত্রে স্থাবর সম্পত্তির জন্য করহার হবে ১৫ শতাংশ, অস্থাবর সম্পত্তির জন্য ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। উদ্দেশ্য দেশে এসব টাকা বিনিয়োগে নিয়ে আসা। আয়কর কর্তৃপক্ষসহ কোনো কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না। যদিও সুযোগটি শুধুমাত্র আগামী অর্থবছরের জন্যই প্রযোজ্য হবে বলে ঘোষণা রয়েছে।
বাজেট উপস্থাপন
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার বেলা ৩টায় জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করেন। তার আগে মন্ত্রিপরিষদে বাজেট অনুমোদিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে সভাপতিত্ব করেন। গতবারের মতো এবারেও বাজেট উপস্থাপনের ক্ষেত্রে তথ্যচিত্র ব্যবহার করেছেন অর্থমন্ত্রী। গতানুগতিকতার বাইরে এসে বাজেট উপস্থাপনাকে আকর্ষণীয় করতেই তার এই উদ্যোগ। তার বক্তৃতার প্রতিটি পর্ব পৃথক তথ্যচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর ওপর বাজেট বক্তৃতার দ্বিতীয় অধ্যায়টি ছিল ‘শেখ হাসিনা :এক ফিনিক্স পাখির গল্পগাথা’। তথ্যচিত্রে এই পর্বটির উপস্থাপনাও ছিল চমৎকার। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার এটি চতুর্থ বাজেট, আর দেশের ৫১তম বাজেট।
বাজেটের আকার
নতুন অর্থবছরের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। যা চলতি ২০২১-২০২২ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ৭৪ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা বেশি। আর সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৮৪ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা বেশি। চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
নতুন বাজেটে রাজস্ব আয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত কর খাত থেকে প্রাপ্তি ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং করের বাইরে রাজস্ব প্রাপ্তি ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
উন্নয়ন বাজেট
২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। এডিপির মোট বরাদ্দের মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস হতে অর্থায়ন করা হবে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬ কোটি ৯ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক উৎস হতে অর্থায়ন ধরা হয়েছে ৯৩ হাজার কোটি টাকা। মূল এডিপির বাইরে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও করপোরেশনের জন্য ৯ হাজার ৩৯০ কোটি ১৮ লাখ টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও করপোরেশনসহ মোট এডিপির আকার দাঁড়ায় ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরে সর্বমোট প্রকল্প থাকছে ১ হাজার ৪৩৫টি, এর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প ১ হাজার ২৪৪টি, কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ১০৬টি। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ৮৫টি প্রকল্প।
ঘাটতি অর্থায়ন
প্রস্তাবিত বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মধ্যে অনুদান খাতে প্রাপ্তি দেখানো হয়েছে ৩ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। ঘাটতি অর্থায়নের মধ্যে অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। ব্যাংক ব্যবস্থা হতে নেওয়া হবে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। ব্যাংক বহির্ভূত উত্স থেকে নেওয়া হবে ৪০ হাজার ১ কোটি টাকা।
রাজস্ব খাতে এনবিআর নিয়ন্ত্রিত ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা করের মধ্যে ভ্যাট খাতে ৩৮ দশমিক ২ শতাংশ, আমদানি শুল্ক বাবদ ১১ দশমিক ৯ শতাংশ, আয়কর খাতে ৩২ দশমিক ৭ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক খাতে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ, অন্যান্য খাতে ১ দশমিক ৪ শতাংশ প্রাপ্তির প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।