বগুড়া শেরপুরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কেল্লাপোশী মেলা শুরু

আরো বিনোদন রাজশাহী সারাদেশ
শেয়ার করুন...

মিন্টু ইসলাম, শেরপুর বগুড়া প্রতিনিধিঃ বগুড়ার শেরপুর উপজেলার অদুরে দু.কিলোমিটার দূরে কেল্লাপোশী মেলা শুরু হয়ে থাকে। তিথি অনুযায়ি প্রতি বছর জ্যেষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার থেকে শেরপুর উপজেলার কুসুম্বী ইউনিয়নের কেল্লাপোশী নামকস্থানে প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে রাজা বাদশাহদের আমল থেকেই এ মেলার আয়োজন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২৯ মে রোববার থেকে শুরু এই মেলা। কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় মেলায় হোন্ডা খেলা, যাত্রা, সার্কাস এর প্যান্ডেলসহ দোকানপাট তৈরীর কাজ চলছে। কেল্লাপোশী মেলার বাসিন্দা মমিন বলেন এবারের কেল্লার মেলা আজ থেকে শুরুর কথা থাকলেও পুরোপুরি শুরু সোমবার থেকেই তাই মেলা চলবে শুক্রবার পর্যন্ত। মেলায় আগত ব্যবসায়িদের কাছ থেকে জানা যায়, একটি দোকান ভাড়াবাবদ ছোট বড় প্রকারভেদে একটি জায়গার ভাড়া ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া ঠিক হয়েছে জেনেছি। মেলায় আগত ব্যবসায়ী মামুন বলেন আমাদের দৈনিক বিদ্যুৎ বিল নিবে ১০০ টাকা একটি লাইটের। কেল্লাপোশী বাজার এলাকার ওমর ফারুক জানান, এবার জাকজমকভাবে মেলা লাগছে এবং মেলার পুরাতন ঐতিহ্য ফিরে আসছে। এই মেলাকে ঘিরে গ্রামে গ্রামে চলে রকমারি আয়োজন। মেলার অন্তত সপ্তাহখানেক আগে থেকেই গ্রামের লোকজন নানা ধরনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। মেলা উপলক্ষে সবাই নিজ নিজ আত্মীয় স্বজনকে দাওয়াত করে বাড়িতে আনেন। বিশেষ করে নতুন জামাই-বউকে নিয়ে সবাই ভিন্ন আনন্দে মেতে ওঠেন। শ্বশুর বাড়ির পক্ষ থেকে জামাই বাবুকে মোটা অঙ্কের সেলামীও দেওয়া হয়। সেই সেলামী আর নিজের গচ্ছিত টাকা দিয়ে জামাই বাবুরা মেলা থেকে খাঁসি বড় মাছ মিষ্টি কিনে শ্বশুর বাড়িতে আনেন। এছাড়া শ্যালক-শ্যালিকাদের নিয়ে মেলা ঘুরে ফিরে দেখেন। মেলায় যাত্রা, সার্কাস, জুয়া,নাগোরদেলা, হুন্ডা, যাদু, পতুল নাচ খেলা দেখিয়ে দিনব্যাপি আনন্দ শেষে ছাতা, ছোটদের কাঠের ও ঝিনুকের তৈরী খেলনা সামগ্রী নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরেন। আর গ্রাম্য মানুষরা সেই মেলা থেকে রকমারি মসলা, তুলা, কাঠের সামগ্রী, বড় বড় ঝুড়ি, চুন সারা বছরের জন্য কিনে রাখেন। এবার কৃষকের ধান নষ্ট হওয়ায় একটু বিপদে আছে। তবে দীর্ঘদিন পর মেলার আনন্দ নিতে কমতি থাকবেনা তারা জানান। অপরদিকে মেলা শুরুর প্রায় সপ্তাহখানেক আগ থেকে গ্রামে গ্রামে চলে মাদার খেলা। একটি বড় বাঁশকে লাল কাপড়ে মুড়িয়ে ও নানা রংয়ে সাজিয়ে সেটির বিভিন্ন স্থানে চুল লাগিয়ে ১৫-২০ জনের একটি দল বেরিয়ে পড়ে। ঢাক-ঢোল, গান-বাজনার নানান সরঞ্জামাদি আর লাঠি নিয়ে তারা গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে শহরে লাঠি খেলা দেখায়। মেলা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত চলে ওই মাদার খেলা। জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার দলটি মেলা এলাকায় অবস্থিত মাজার প্রাঙ্গনে গিয়ে তা শেষ করে। মেলায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কেনা কাটার ধুম। দূর-দূরান্ত থেকে আগত বিক্রেতারা এখানে দোকান সাজিয়ে বসেন। এ মেলার প্রধান আকর্ষণ হলো বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাবপত্র, মিষ্টি-ফলমূল, নানা জাতের বড় বড় মাছ, কুঠির শিল্প সামগ্রী, মহিষ ও খাসির মাংস, রকমারি মসলার পসরা। এদিকে, প্রতিটি মেলার পিছনেই কিছু না কিছু লোকগাঁথা কথা থাকে। কেল্লাপোশী মেলা সম্পর্কে তেমনি একটি লোক গাঁথার কথা জানা যায়। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এ মেলা হয়ে আসছে বলে কথিত আছে। বৈরাগ নগরের বাদশা সেকেন্দারের একজন ওরশজাত এবং একজন দত্তক পুত্র ছিলেন। ওরশজাত পুত্রের নাম ছিল গাজী মিয়া আর দত্তক পুত্রের নাম কালু মিয়া। গাজী মিয়া দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন। তারা রাজ্যের মায়া ত্যাগ করে ফকির সন্যাসীর বেশ ধারণ করে ঘুরতে ঘুরতে ব্রাহ্মন নগরে আসেন। সেখানে ব্রাহ্মন রাজমুকুটের একমাত্র কন্যা চম্পা গাজীকে দেখে মুগ্ধ হন। একপর্যায়ে তারা দু’জন দু’জনকে ভালবেসে ফেলেন। পালিত ভাই কালু মিয়া বিষয়টি জানতে পেরে গাজীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মুকুট রাজার নিকট যান। মুকুট রাজা ফকির বেশী যুবকের এরূপ স্পর্ধা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বন্দি করেন। এতে গাজী মিয়া দারুন আঘাত পান। তিনি মুকুট রাজার নিকট থেকে ভাই কালু মিয়াকে উদ্ধারের জন্য কেল্লাপোশী নামক স্থানে একটি দূর্গ নির্মাণ করেন। পরে রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করে ভাইকে উদ্ধার এবং তার কন্যাকে বিয়ে করেন। আর তিথি অনুযায়ি ওই দিনটি ছিল জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার। ওই সময় গাজীর বিয়ে উপলক্ষে কেল্লাপোশী দূর্গে নিশান উড়িয়ে তিন দিনব্যাপি আনন্দ উৎসব চলে এবং সেখানে মাজার গড়ে তোলা হয়। মেলা চলাকালে সেখানে ভক্তরা আসর বসায়। ওই দিনগুলোকে অস্মান করে রাখতে প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার থেকে তিন দিনব্যাপি মেলা বসে। আর এই মেলা উপলক্ষে এলাকাবাসি নতুন জামাইকে ঘরে এনে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন। এছাড়া নিকট আত্মীয় স্বজনের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শেরপুর থানার অফিসার ইনচার্জ শহিদুল ইসলাম বলেন, গ্রামীণ এই মেলার অনুমতি দেয়া হয়েছে। যেহেতু মেলাতে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি ঘটে। তাই সেখানকার আইনশৃখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।

image_pdfimage_print

শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published.