আনোয়ার আলদীনঃ গণপরিহনে হাফ পাস নির্ধারণের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনগণপরিহনে হাফ পাস নির্ধারণের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন
গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের জন্য ‘হাফ পাস’ বা অর্ধেক ভাড়া নির্ধারণের দাবিতে আন্দোলন করছেন রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। চলতি মাসে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাসভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়িয়ে বিআরটিএর আদেশ আসার পর ছাত্রদের সঙ্গে বাসভাড়া নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে।
ফলে এই হাফ ভাড়া নিয়ে নিরুপায় হয়ে ছাত্ররা রাজপথে নামেন। শিক্ষার্থীরা তাদের জন্য ‘অধিকার’ অর্ধেক ভাড়া চালুর দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু দাবি মানার ব্যাপারে সরকার আশ্বাস দিলেও বাসমালিকরা নারাজ। ৫৭ বছর আগে থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ পাস প্রথা চলে আসছে। তবে লিখিত কোনো আইন নেই।
জানা যায়, ঢাকা শহরে মোট যাত্রীর মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার বিষয়টি দাবি নয়, অধিকার। সরকারি প্রজ্ঞাপন বা ঘোষণা না থাকলেও স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান আমল থেকে তারা এই অধিকার ভোগ করে এসেছে। এই হাফ ভাড়ার প্রচলন সম্পর্কে অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের(এআরআই) সাবেক পরিচালক ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, সম্ভবত ১৯৬৪ সালে বিআরটিসি চারটি বাস দিয়ে সরকারিভাবে গণপরিবহন সেবা দেওয়া শুরু করে। তখন থেকে সরকারের নির্দেশে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নেওয়া হতো। এটা ছিল সম্পূর্ণ সরকারি সেবা। পরবর্তী সময় যখন সরকারি বাসের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি বাস গণপরিবহনের সেবা দেওয়া শুরু করে তখন সরকারি বাসের নিয়মে বেসরকারি বাসেও ছাত্রদের হাফ ভাড়া নেওয়া হতো। এ বিষয়ে লিখিত নিয়ম না থাকায় এটা প্রথা হয়ে দাঁড়ায়, যা পরবর্তী সময় বেশ কিছুদিন চলে। কিন্তু সরকার যেহেতু বেসরকারি বাস কোম্পানির সঙ্গে কোনো চুক্তি করেনি সেহেতু হাফ ভাড়া নিতে তারা বাধ্য নয়। তবে সাধারণ যাত্রীদের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে বেসরকারি গণপরিবহনের সঙ্গে সরকারের যদি চুক্তি থাকত, বিআরটিএর নির্ধারিত ভাড়া ছাড়া অতিরিক্ত ভাড়া না নেওয়াসহ ছাত্রদের হাফ ভাড়া বিষয়ে চুক্তি থাকত তাহলে ভালো হতো এবং এত তর্কবিতর্ক হতো না। অথচ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বেসরকারি গণপরিবহনের সঙ্গে সরকার চুক্তি করে থাকে।
ইতিহাস বলছে, আন্দোলন করে ছাত্ররা এই অধিকার অর্জন করেছে। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবির একটি ছিল ‘হাফ ভাড়া’ নির্ধারণ। পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ঘোষিত এই ১১ দফা দাবির একটি ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া রাখা। দাবির ১ (ঢ) দফা অনুসারে, ‘‘ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের ‘আইডেন্টিটি কার্ড’ দেখাইয়া শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ‘কন্সেসনে’ (ছাড়ে) টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকিটেও ‘কন্সেসন’ দিতে হইবে।’’
পরে তত্কালীন সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানের সামরিক আদেশে বাসভাড়া সম্পর্কে নির্দেশনায় বলা হয়, ‘‘পশ্চিম পাকিস্তানের মতো বাসে ১০ পয়সা ভাড়ায় শহরের যে কোনো স্থানে যাতায়াতের ব্যবস্থা করিতে হইবে। দূরবর্তী অঞ্চলে বাস যাতায়াতেও শতকরা ৫০ ভাগ ‘কন্সেসন’ (ছাড়) দিতে হইবে। ছাত্রীদের স্কুল-কলেজে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে। সরকারি ও আধা সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের শতকরা ৫০ ভাগ ‘কন্সেসন’ দিতে হইবে।’’
তখনকার সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা ও বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনে ইয়াহিয়া খানের সামরিক আদেশে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া প্রদানের বিষয়টি বাস্তবায়িত হয়। তবে এটা আইন দ্বারা হয়নি। এই ধারা স্বাধীনতার পরও বহু বছর চালু ছিল। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, অর্ধেক ভাড়ার বিষয়টি নেই। এদিকে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা অনেকটা রীতি হিসেবে এতদিন গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়া দিয়ে আসলেও কোনো কোনো পরিবহন কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের এই অধিকারের প্রতি অবজ্ঞা করে আসছিল।
তারপর সম্প্রতি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া। বিশেষ করে ঢাকা শহরের তথাকথিত ‘সিটিং সার্ভিস’ লিখে অধিকাংশ বাস শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি তোয়াক্কা করছিল না। উলটো হাফ ভাড়ার দাবি তোলা শিক্ষার্থীদের তারা হয়রানি করছিল। এ নিয়ে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে। এর আগে ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ঢাকা অবরোধ করা শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির ভেতরে অন্যতম ছিল, ‘শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’ শিক্ষার্থীদের ৯ দিন ধরে চলা ২০১৮ সালের তুমুল আন্দোলনের পর প্রণয়ন হয় সড়ক পরিবহন আইন। তবে উপেক্ষিত থাকে হাফ পাশের বিষয়টি।
যদিও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অন্তত দুই দফা মৌখিকভাবে হাফ পাশ কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে লিখিত না হওয়ায় মৌখিক এই নির্দেশের তোয়াক্কা করেনি বাসমালিকরা। যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, ঢাকা শহরে মোট যাত্রীর মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। তাদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিলেও পরিবহন মালিকদের লোকসান দিতে হবে না। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিলে পরিবহন শ্রমিকদের যে পরিমাণ আয় কমে যাবে, তার চেয়ে অনেক বেশি তারা লাভবান হবেন পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি বন্ধ হলে।
এদিকে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের জন্য বাস, লঞ্চ ও ট্রেনে ভাড়া অর্ধেক করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়েছে গত বুধবার। রিটে আবেদনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব, রেলপথ মন্ত্রণালয় সচিব ও পুলিশের আইজিকে বিবাদী করা হয়েছে। সূত্রঃ ইত্তেফাক