মোঃ আতিকুর রহমান, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধিঃ-প্রকৃতিক সেন্দৈর্যের লীলাভুমিখ্যাত তাহিরপুর উপজেলাটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর।এই উপজেলাটিতে রয়েছে তিনটি স্থল-বন্দর। যে স্থল-বন্দরগুলো দিয়ে প্রতিদিন ভারত থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে হাজার হাজার মে.টন কয়লা ও চুনাপাথর।তাহিরপুরের এই আমদানীখাত থেকে সরকার প্রচুর পরিমান রাজস্ব আয় করে থাকেন।কিন্তু এই শুল্ক ষ্টেশনগুলো থেকে কোটি কোটি টাকা চাদা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে দীর্ঘ দিনের। এই চাদাবাজির বিষয়ে এলাকার ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময়ে দুদকসহ জেলা উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করলেও রহস্যজনক কারনে সবাই নিরব ভূমিকা পালন করে আসছেন। খুজ নিয়ে জানা যায়, এই আমদানীখাতের চাদাবাজির টাকা জেলা কাষ্টম অফিস, বিজিবি, রাজনৈতিক মহলসহ বিভিন দপ্তরে ভাগ বাটোয়ারা হয়। উল্লেখ্য,এই তিনটি শুল্ক ষ্টেশনের একটিতেও ওজন পরিমাপের কোন যন্ত্র না থাকায় অবৈধ সূযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা আর ফায়দা লুটছে ল্যান্ড কাষ্টম’সসহ বিভিন্ন মহল আর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
তবে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রেরিত এক নির্দেশের কারনে এসব বিষয় নিয়ে তৎপর হয়েছে জেলায় দ্বায়িত্বরত সরকারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থাদের তথ্য অনুযায়ী, এই তিনটি শুল্ক ষ্টেশন দিয়ে বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ১০০০(এক হাজার) ট্রাক চুনাপাথর প্রতিদিন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী প্রতিটি ট্রাকের মধ্যে ১২ মে.টন চুনাপাথর থাকার কথা থাকলেও প্রতিটি ট্রাকে মূলত ১৮ থেকে ২০ মে.টন চুনাপাথর আসে । এই বাড়তি মালের টাকাগুলো এলাকার কিছু হুন্ডি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে যাচ্ছে ভারতের রপ্তানীকারকদের কাছে। আর এই বাড়তি চুরাপাথর আনতে প্রতি মে.টন হিসাবে দ্বায়িত্বরত ল্যান্ড কাষ্টম’স ও বিজিবি সদস্যদেরকে দিতে হচ্ছে নির্দিষ্ট পরিমান চাদা। সরকারী হিসেবে একটি এলসিতে ২০০ মে.টন চুনাপাথর দেখানো হলেও মূলত চুনাপাথর আসছে ৩০০ থেকে ৩২০ মে.টন। এতে করে একদিকে প্রতিদিন হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে দেশের কোটি কোটি টাকা আর অপরদিকে প্রতিদিন গড়ে কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
গোয়েন্দা সংস্থাদের প্রেরিত রিপোর্ট অনুযায়ী এই শুল্ক ষ্টেশনগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে বিশ লাখ টাকা চাদাবাজি হওয়ার তথ্যও পাওয়া যায়। এই শুল্ক ষ্টেশনগুলোর একটিতে বাগলী চুনাপাথর ও কয়লা আমদানীকারক সমিতি নামীয় ভোয়া সাইনবোর্ড ব্যাবহার করে দীর্ঘদিন ধরেই চলছে বেপরোয়া চাদাবাজি। এ ব্যাপারে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেও কোন ফল না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জেলায় দ্বায়িত্বরত গোয়েন্দা সংস্থারা। এই শুল্ক ষ্টেশনটির চাদাবাজির কারনে দিনে দিনে কমছে আমদানীকারকের সংখ্যা, কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এ পর্যন্ত অনেক ব্যাবসায়ীরাই এ স্থল বন্দর ত্যাগ করে পাড়ি জমিয়েছেন তামাবিল, সুতারকান্দি, হালুয়াঘাট, ভুড়িমাড়িসহ জাফলং স্থল বন্দরে। অপরদিকে চাঁদাবাজির টাকা থেকে অর্জিত অর্থে রাতারাতি সম্পদের পাহাড় গড়েছেন সমিতির সভাপতি খালেক মোশারফ, সাধারন সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির, অর্থ সম্পাদক বিজিবি সোর্স আলী হোসেনসহ আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহিদুল হায়দার লিটন। এ চাঁদাবাজি বন্ধ না করা গেলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ স্থলবন্দরটি দিয়ে যেকোনো সময়ে আমদানি কার্যক্রম বন্ধের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসীসহ গোয়েন্দা সংস্থারা।
অত্র এলাকার ব্যবসায়ীরা জানান, আমরা ব্যবসায়ীরা প্রতিটি এলসিতে সরকার বাহাদুর নির্ধারিত কর পরিশোধ করে ভারত থেকে কয়লা চুনাপাথর আমদানি করে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করি। কিন্তু বাগলি চুনাপাথর আমদানি কারক সমিতি নামীয় একটি অবৈধ সমিতির চাঁদাবাজির কারনে হুমকির মুখে পড়েছে আমাদের ব্যবসা। আমাদের আমদানিকৃত চুনাপাথর বাংলাদেশে যখন আসে তখন প্রতিটি ট্রাকে এই সমিতিকে ৮০ টাকা করে চাদা দিতে হয়। আবার আমরা যখন আমাদের আমদানিকৃত কয়লা ও চুনাপাথর বিক্রি করতে যাই তখন প্রতি বিশ মে.টন চুনাপাথরে ৫০০টাকা চাদা দিয়ে সমিতির স্লিপ নিতে হয় কিন্তু সমিতি’র স্লিপে উল্লেখ করা হয় ৫০ টাকা। এই চাঁদা আদায়ের রশিদগুলোর কোনটাতেই বহি নম্বর দেয়া থাকে না। ৫০ টাকার স্লিপ দিয়ে ৫০০ টাকা কেনো রাখা হচ্ছে এই প্রশ্ন জানতে চাইলেই তাদের পালিত সেন্ট্রি নামীয় লাঠিয়াল বাহিনীর দ্বারা নৌকা আটক করে রাখা হয়।
এছাড়াও নতুন ব্যাবসায়ীদের সমিতিতে অন্তর্ভুক্ত করার সময়ে সমিতির নামে ২০ হাজার টাকার রশিদ দিলেও ম‚লত প্রতি সদস্য থেকে ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। বিগত ৫ বছরে কয়লা আমদানিকারক সমিতির অধীন নদী পথে প্রতিদিন প্রায় ৩শ ষ্টিল বডির বাল্কহেড নৌকা ও কার্গো কয়লা, চুনা পাথর পরিবহন করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়। এসব কয়লা ও চুনা পাথরবাহী নৌকা থেকে আমদানিকারক সমিতির নাম ভাঙিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩লাখ টাকা চাঁদা আদায় করছে এই চক্রটি।বাগলি চুনাপাথর আমদানিকারক সমিতির নামে কোটি কোটি টাকা চাঁদা উত্তোলন করলেও কোনদিন সমিতি এলাকার রাস্তাঘাটের কোনো উন্নয়ন করেনি বলে অভিযোগ ব্যাবসায়ীদের।
স্থানীয়দের দাবি, ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত কত কোটি টন কয়লা ও চুনাপাথর এ শুল্ক ষ্টেশন দিয়ে আমদানি হয়েছে তার সঠিক হিসাব পাওয়া যাবে সরকারের রাজস্ব বিভাগে। এ হিসাব টানলেই তাদের সঠিক চাঁদা আদায়ের হিসাব বের হয়ে আসবে।
২০১৭ সালের আগে পর্যন্ত এই সমিতির কোন বৈধতা না থাকলেও ২০১৭ সালের ১৮ই মে সমাজ কল্যান মন্ত্রনালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে সমিতিটির নিবন্ধন করা হয় যার নিবন্ধন নং-সুনাম-৯৩৬/১৭।যদিও সমাজ সেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধনে আমদানীকারক সমিতির বৈধতা কতোটুকু এ ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যায়? সমাজসেবা অধিদফতর হতে ১৯৬১ সালের স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) ৪৬ নং অধ্যাদেশ অনুযায়ী যে ১৫টি কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য সমাজসেবা অধিদফতর হতে নিবন্ধন প্রদান করা হয় তার কোন ক্যাটাগরির মধ্যে উক্ত সমিতিটি না পড়লেও আইনের কোন তোয়াক্কা না করেই সমাজসেবা অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে তারা অনায়াসেই চালিয়ে যাচ্ছে তাদের চাদাবাজির রাজত্ব।
গোয়েন্দা সংস্থাদের তথ্যমতে, সমিতির সভাপতি খালেক মোশারফ তাহিরপুর উপজেলা বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। বিএনপির শাসনামলে তার ভয়ে সব সময়ই এলাকার আওয়ামীলীগ নেতারা আতঙ্কে থাকতেন। তিনি বিভিন্ন মেয়াদে একাধারে তাহিরপুর উপজেলা বিএনপির সদস্য, তাহিরপুর উপজেলা যুবদলের সহ-সভাপতি এবং ১নং শ্রীপুর(উত্তর) ইউনিয়ন যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে দীর্ঘদিন দ্বায়িত্বে ছিলেন। বিএনপির কয়েকটি সাংগঠিনক পদে বহাল থাকাবস্থায় বিএনপির কোন কমিটি থেকে পদত্যাগ না করেই ২০১৪ সালে তিনি তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের একজন প্রভাবশালী নেতার হাত ধরে আওয়ামীলীগের রাজণীতিতে প্রবেশ করেন। দলে প্রবেশ করার পর পরই তিনি সেই নেতার ঘনিষ্টজন হিসেবে এলাকায় পরিচিতি লাভ করেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে ১ বছরের মধ্যেই উপজেলা আওয়ামীলীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক হিসেবে পদায়ন হন। উল্লেখ্য ২০১৬ সাল পর্যন্ত উপজেলা যুবদলের কমিটির মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি বিএনপির উপরোল্লিখিত পদগুলোতেও বহাল ছিলেন । তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের কমিটিতে স্থান পাওয়ার পর পরই তিনি একাধারে বাগলী চুনাপাথর ও কয়লা আমদানীকারক সমিতির সভাপতি, বাগলি বাজার কমিটির সভাপতি,বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল বাজার কমিটির সভাপতি, বাগলি উচ্চ বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, বীরেন্দ্র নগর উত্তরপাড়া মসজিদ কমিটির সভাপতি পদে আসীন হন। বাগলী বাজারে আমদানীকারক সমিতির অফিস বানিয়ে শুরু হয় তাদের চাদাবাজির রাজত্ব। অপরদিকে সমিতির সাধারন সম্পাদক ডা. এনিরুজ্জামান মনির শিবির নেতা হিসেবেই এলাকাতে পরিচিত । বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে আতাত করে আওয়ামীলীগের প্রার্থীকে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে সে জামায়াত মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করে। আওয়ামীলেিগর ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ১নং ওয়ার্ডে তার বাড়ি হওয়ার সুবাদে সে ভেঙ্গে দেয় আওয়ামীলীগের ভোট ব্যাংক এবং শুধুমাত্র এই কেন্দ্রে আওয়ামীলীগের প্রার্থী ভোট কম পাওয়ায় মাত্র ৩২৩ ভোটে পরাজিত হয় নৌকা প্রতীক মনোনীত প্রার্থী। সেই মনিরুজ্জামান মনির বর্তমানে ১নং শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক। অপরদিকে সমিতির অর্থ সম্পাদক বিজিবি সোর্স আলী হোসেনের ছোট ভাই কামাল মিয়া ১নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি হিসেবে দ্বায়িত্বে রয়েছে।
দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকার সুফল দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা ভোগ করতে না পরলেও খালেক মোশারফ, মনিরুজ্জামান মনির ও আলী হোসেনের মতো সুবিধাবাদীরা ঠিকই ভোগ করেছেন। চাদাবাজীর অর্থে আয়েশী জীবন যাপনসহ বাগলী বাজারে গড়ে তুলেছেন ইরা প্লাজা নামীয় বহুতল ভবন, ময়মনসিংহ শহরের কোতোয়ালী মডেল থানার কাশর করোনেশন রোডে স্ত্রী অজিফা মোশারফের নামে গড়েছেন বিলাসবহুল বাড়ি যার নামকরন করা হয়েছে মিলি/ইরা ভাগলী নিবাস।
এ ব্যাপারে জানতে সমিতির সভাপতি খালেক মোশারফের ব্যাক্তিগত মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমি ২০১৪ সালে আওয়ামীলীগে যোগদান করার সময় যুবদলের উপজেলা সহ-সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ না করলেও আমার জানামতে উপজেলা কমিটির নেতৃবৃন্দ আমাকে বহিস্কার করেছিলেন। কিন্তু এখন আপনার মাধ্যমে জানতে পারলাম তারা আমাকে বহিস্কার করেননি, ২০১৬ সাল পর্যন্ত আমি ওই পদে বহাল ছিলাম। সমাজ সেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধনে আমদানীকারক সমিতির কার্যক্রম চালানো যায় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধনে আমদানীকারক সমিতির কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়না তার জন্য বানিজ্য মন্ত্রনালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। সমিতির নামীয় ৫০ টাকার স্লিপ দিয়ে ৫০০ টাকা কেনো রাখা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে সমিতি তৈরির পর থেকেই এভাবে চলে আসছে তাই আমিও এভাবেই চালাচ্ছি।
এ ব্যাপারে তাহিরপুর উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা তৌফিক আহমেদ জানান,আমদানীকারক সমিতির নিবন্ধন দেওয়ার অধিকার সমাজ সেবা অধিদপ্তরের নেই, কিভাবে তারা সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নিয়েছে তা আমার বোধগম্য হচ্ছেনা। আর সমাজ সেবা অফিসের নিবন্ধিত সমিতির নামে চাদা তোলারও কোন নিয়ম নেই। যদি কেউ এ ব্যাপারে আমার কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন তাহলে আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবো।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো:রায়হান কবিরকে অবগত করা হলে তিনি জানান, অবশ্যই এ ব্যাপারে খুজ খবর নিয়ে আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করব। সরকারের সুনাম ক্ষুন্ন হয় এমন কাজ আমি কাউকেই করতে দেবোনা।