ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন স্বৈরাচার সরকারের দোসর ইউপি চেয়ারম্যান একরার

আইন-অপরাধ আরো পরিবেশ সারাদেশ সিলেট
শেয়ার করুন...

এম আর সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি:
সিলেট মহানগর আওয়ামী যুবলীগের স্বশস্ত্র ক্যাডার, সুনামগঞ্জ জেলা যুবলীগের সদস্য ও বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে নির্বাচিত কুলঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান একরার হোসেনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হাতিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের কোমলমতি শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ গ্রামের সর্বস্থরের মানুষ।

ভাটি অঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা ওই কুখ্যাত চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন থানায় খুঁন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণসহ ছাত্র আন্দোলনে নিরন্ত্র শিক্ষার্থীদের উপর গুলি বর্ষণের অভিযোগে একাধিক মামলা বিচারধীন রয়েছে।

এদিকে ৫ আগস্টের পর দেশের দৃশ্যপটের পরিবর্তণ হলেও এখানো বেপরোয়া স্বৈরাচার সরকারের দোসর একরার। এখনো সন্ত্রাসী বাহিনীর দ্বারা এলাকায় অস্ত্রের মহড়া দিয়ে সাধারন মানুষের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে বন্ধ করে দেয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফটক। শিক্ষকসহ শিক্ষার্থীদের মারধর করায় স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। ভাড়াটে সন্ত্রাসী দ্বারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে অস্ত্রের মহড়া করায় ভয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা তাদের স্কুলে আসতে দেন না। এতে করে লেখাপড়ায় মারাত্বক ক্ষতি হয় শিক্ষার্থীদের।

শুধু এতেই কান্ত হয়নি সন্ত্রাসী চেয়ারম্যান একরার। বিগত সরকারের দোসর সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠে। গ্রামবাসী এর প্রতিবাদ করলে তাদের হামলা-মামলা দিয়ে হয়রানি করে। সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে নিরীহ মানুষের উপর আক্রমন করে একাধিকবার। এলাকায় গভীর রাতে মানুষের বাড়ির পাশে গিয়ে গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। তার ভয়ে রাতে ঘর থেকে বের হন না গ্রামবাসী। ৫ই আগস্টের পর থেকে সন্ত্রাসী একরার পলাতক থাকলেও যখনই এলাকায় আসে আতঙ্ক বিরাজ করে গ্রামবাসীর মাঝে। চারপাশে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে বেশ কয়েকবার এলাকায় এসেছে সে। যখনই এলাকায় আসে ভয়ে তটস্থ থাকেন গ্রামবাসী। তার এসব অপকর্ম, অত্যাচার-নির্যাতন ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে একাধিকবার মামলাসহ সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবরে অভিযোগ দায়ের করলেও অদৃশ্য ক্ষমতাবলে এখনো ধরাছোয়ার বাইরে রয়েছে। স্বৈরাচার সরকারের পতন হলেও এখনো পতন হচ্ছে না ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের দোসর চেয়ারম্যান একরারের। যার কারনে আতঙ্কে দিন কাটছে হাতিয়া গ্রামের সর্বস্থরের মানুষের। বেশ কিছুদিন আগে তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে রামদা, চাকু, লোহাড় রড, এককাইট্রাসহ বিভিন্ন ধরনের ধারালো দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করে যৌথ বাহিনী। এসময় কৌশলে পালিয়ে যায় অস্ত্রের মজুদদাতা একরার হোসেন। অভিযানে দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করলেও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে থাকা প্রাণঘাতি অস্ত্রের ভয়ে শঙ্কায় দিনরাত কাটে হাতিয়া গ্রামের মানুষের। ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের ছুড়া গুলিতে কখন যে কার মায়ের বুক খালি হয় সে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দিরাই উপজেলার কুলঞ্জ ইউপি’র চেয়ারম্যান হিসাবে হাতিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের গভর্নিংবডির দ্বায়িত্বে থাকা অবস্থায় নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ এনে সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষের নিকট একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন শিশু মিয়া নামের এক শিক্ষার্থীর অবিভাবক। পরে ওই অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় গত ২০২৩ সালের ১৮ ই ডিসেম্বর তারিখে সিলেট মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশে ওই কমিটি ভেঙ্গে দেয়া হয়। পরে একরার হোসেন হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলেও তা খারিজ হয়ে যায়। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন ইউপি চেয়ারম্যান একরার হোসেন। বিদ্যালয়ের ক্ষতি সাধনের চেষ্ঠায় লিপ্ত হন তিনি। একাধিকবার ওই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হেলাল উদ্দিনকে তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে দেশীয় অস্ত্র দ্বারা প্রানে মারার উদ্দ্যেশে মারধর করে রক্তাক্ত জখম করে সেই সাথে বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় কাগজাদি ও নগদ অর্থ লোট করে নিয়ে যায়। সেই সাথে হাতে থাকা অস্ত্র থাক করে এ বিষয়ে কোন মামলা বা আইনের আশ্রয় নিলে ওই শিক্ষককে প্রানে হত্যার হুমকি প্রদান করে। এছাড়াও আরো একাধিক শিক্ষক ও গ্রামবাসী তার অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হন। এছাড়াও কমিটি ভেঙ্গে দেয়ার পর বিদ্যালয়ের আর্থিক লেনদেনসহ যাবতীয় হিসাব বুঝিয়ে দেয়ার জন্য একরার হোসেনকে অনুরোধ জানালে তিনি হিসাব দিতে ব্যার্থ হন। ব্যাংক স্টেটমেন্ট অনুযায়ী দেখা যায়, ব্যাংকে কোন প্রকার টাকা জমা না দিয়ে নিজের খেয়াল খুশিমত বিদ্যালয়ের প্রায় ৬০-৭০ লক্ষ টাকা লুট করে নেন।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ভেঙ্গে যাওয়া ওই কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করার পর এডহক কমিটি গঠনের অনুমতি প্রদান করা হলে সর্বসম্মতিক্রমে একটি মিটিং এর আয়োজন করা হয়। আর এতে বাঁধা দেন চেয়ারম্যান একরার হোসেন। তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে বিদ্যালয়ের ফটকে থালা ঝুলিয়ে রাখেন। পরবর্তীতে প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে।

অভিযোগ উঠেছে যুবলীগ নেতা একরার হোসেন ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই এলাকায় চাঁদাবাজি ও অস্ত্রবাজি বেড়েই চলছে। যে কোন কাজে তাদেরকে বড় অংকের চাঁদা দিতে হতো। এছাড়াও চেয়ারম্যানের আপন ছোট ভাই এম.সি কলেজ ছাত্রদলের সাবেক আহব্বায়ক বদরুল আজাদ রানা ভাড়াটে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী এনে এলাকায় পুরো গ্রামে নিরবে চাঁদাবাজি করতেন। তাদের ভয়ে এলাকার মানুষ জিম্মি দশায় দিনাতিপাত করে।
জান যায়, হাতিয়া স্কুল এন্ড কলেজের একটি ৪ তলা ফাউন্ডেশন বিশিষ্ঠ একটি কাজে চেয়ারম্যান একরার হোসেন ঠিকাদারের কাছে ১০ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবী করে। বিষয়টি জানার পর গ্রামবাসী এর প্রতিবাদ করলে তাদেরকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ওই স্কুলের গেইটসহ দরজা, জানালা ভেঙ্গে কয়েক লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি সাধন করে। স্কুলের সভাপতি থাকাবস্থায় তিন বছরে প্রায় ৫৫ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করে। এছাড়ও সরকারি বরাদ্দকৃত অসহায় মানুষের দুই লক্ষ টাকার চাল সে নিজেই আত্মসাৎ করে। জলমহাল, গরুর হাট, সরকারী খাস জায়গা দখলসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে ইউপি চেয়ারম্যান একরার হোসেনের বিরুদ্ধে।

বিগত সরকারের আমলে সরকারি ঘরের জন্য জনপ্রতি ২০ হাজার টাকা করে ঘোষ দিয়ে নিজের আত্মীয় স্বজনদের ঘর পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ অনেক অসহায় পরিবারের। শুধু তাই নয় কুলঞ্জ ইউপিতে নাগরিক সেবা পেতে হলে প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত অর্থের। কোন নীয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে মনগড়া আইন তৈরী করেছেন নিজের এলাকায়। একাধিক অপকর্ম করে বেড়ালেও অদৃশ্য কারনে তাকে আজোব্দি গ্রেফতার করতে পারছেনা পুলিশ। তার অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে দ্রুত তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবী স্থানীয়দের।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাতিয়া স্কুল এন্ড কলেজের এক শিক্ষার্থী জানান, আমরা প্রতিদিন বিদ্যালয়ে আসলেই একরার চেয়ারম্যানের সন্ত্রাসী বাহিনীকে বিদ্যালয়ের পাশে অস্ত্র হাতে নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখি। ভয়ে আমরা বিদ্যালয়ে আসতে পারি না। আমাদের বাবা-মা এসব ঘটনা শুনলে আমাদের বিদ্যালয়ে আসতে দেন না। এতে আমাদের লেখাপড়ার মারাত্বক ক্ষতি হচ্ছে। ওই সন্ত্রাসী বাহিনী অনেক সময় আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ভাই বোনদের মারধর করে ভয়ভীতি দেখায়। আমরা এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। অনেক শিক্ষার্থী স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে। আমরা এই চেয়ারম্যানের সন্ত্রাসী বাহিনীর হাত থেকে মুক্তি চাই। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ করতে চাই।

এ বিষয়ে হাতিয়া গ্রামের জহিরুল ইসলাম বলেন, একরার চেয়ারম্যান ও তার ভাই বদরুল আজাদ রানার সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে আমরা গ্রামে জিম্মি দশায় দিনাতিপাত করছি। অবৈধ অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তারা গ্রামে নিরব চাঁদাবাজি চালিয়ে আসছে। এছাড়াও তাদের বাড়িতে অবৈধ অস্ত্র ও সন্ত্রাসীদের কারখানা গড়ে তোলেছে। যৌথবাহিনীর অভিযানে কিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হলেও বাকি অস্ত্র রয়ে গেছে। তাদের পালিত সন্ত্রাসীরা এলাকায় অস্ত্রের মহড়া করে ঘুরে বেড়ায়। ফাকা গুলি ছুড়ে মানুষকে আতঙ্কে রাখে। আমরা গ্রামবাসী একরার বাহিনীর অত্যাচার থেকে মুক্তি চাই। তাকে যেন দ্রুত প্রশাসন আইনের আওতায় এনে দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তির ব্যাবস্থা করে আমরা গ্রামবাসী এই জোর দাবী জানাই।
এ বিষয়ে হাতিয়া হাতিয়া স্কুল ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন জানান, কুলঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান হাতিয়া স্কুল ও কলেজের গভর্নিবডির সভাপতি থাকাবস্থায় নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে একজন অবিভাবক সংশ্লিষ্ঠ দপ্তরে একটি লিখিত অভিযোগ দিলে তার সত্যতা পাওয়ায় ওই কমিটি ভেঙোগ দেয়া হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন ওই চেয়ারম্যান। পরবর্তীতে একাধিকবার আমাকে তার সন্ত্রাসী বাহিনী দ্বারা মারধর ও হত্যার হুমকি প্রদান করেন। এমনকি কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরও তিনি মারধর করেন। ভয়ে অনেক ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে আসে না। আমরা এ থেকে মুক্তি চাই। সুন্দর পরিবেশে বিদ্যালয়ে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কাম,না করি।

এ বিষয়ে হাতিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি জানান, স্বৈরাচার সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে তার দোসর একরার চেয়ারম্যানের অত্যাচারে আমরা গ্রামবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠি। নানা সময় মিত্যা হামলা মামলায় আমাদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালায় সে। ভোট কারচুপির মাধ্যমে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েই বেপরোয়া হয়ে উঠে সে। তার ভয়ে এলাকার মানুষ রাতে ঘর থেকে বাহির হতে পারে না। অস্ত্রের ভয়ে পুরো গ্রামবাসী তটস্থ করে রেখেছে একরার চেয়ারম্যান। আমরা তাকে দ্রুত গ্রেফতারের দাবী জানাই। আতঙ্ক ছাড়া সুন্দর পরিবেশে আমরা গ্রামের মানুষ বাঁচতে চাই।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত চেয়ারম্যান একরার হোসেনের মোবাইল ফোনে বার বার কল দিলেও বন্ধ পাওয়ায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয় নি।

এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার আ.ফ.ম আনোয়ার হোসেন খাঁন জানান, কুলঞ্জ ইউপি’র কুখ্যাত চেয়ারম্যান ও তৎকালীন সরকারের দোসর একরার চেয়ারম্যানকে ধরতে আমরা বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করি। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা চলমান রয়েছে এবং তার হেফাজত থেকে বেশ কিছু অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তাকে দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।


শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published.