বাংলাদেশিদের বিদেশে সম্পদের খোঁজে তৎপর বিভিন্ন সংস্থা :দূর্বারবিডি

অর্থনীতি আইন-অপরাধ জাতীয় প্রবাস
শেয়ার করুন...

বিদেশে বাংলাদেশিদের সম্পদের অনুসন্ধানে তৎপরতা বেড়েছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার। বিশেষ করে দেশ থেকে অর্থ পাচারে এগিয়ে রয়েছে সরকারি চাকরিজীবীরা- পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর সক্রিয় হয়ে উঠেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বলেছিলেন, কানাডার টরেন্টোতে বাড়ি করেছেন- এমন বাংলাদেশিদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ২৮টি ঘটনার অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তা। এরপরই নড়েচড়ে বসে সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি উচ্চ আদালত থেকেও তাদের তথ্য চাওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বলছে, সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপারে এখনও তারা সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পায়নি। তবে পাচার বন্ধে কৌশলপত্র তৈরির কাজ করছেন তারা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, টাকার বন্ধের ব্যাপারে দেশে আইন-কানুনের কোনো অভাব নেই। কিন্তু এর বাস্তবায়নে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বুধবার যুগান্তরকে বলেন, কানাডার টরেন্টোতে যেসব বাংলাদেশিদের ঘরবাড়ি আছে, সেখানে আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছিলাম, এর মালিক কারা। তাতে সরকারি চাকরিজীবী বেশি।

তবে এটি কোনো অফিসিয়াল বা সরকারি জরিপ নয়। সে কারণে কোনো ভেরিফাইড রিপোর্ট পাইনি। আমরা ব্যক্তিগতভাবে তথ্য নিয়েছি। আর কীভাবে তারা টাকা নিয়েছে, সেটি এখনও পরিষ্কারভাবে বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আপনারাও নিজস্ব সোর্স থেকে বা বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন।

জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের অর্থ পাচারের অপরাধ তদন্তের আইনি এখতিয়ার দুদকের রয়েছে। যেসব সরকারি কর্মকর্তা দেশের বাইরে অর্থ পাচার করছেন, কানাডার বেগমপাড়াসহ অন্যান্য বাড়িঘর করেছেন, তাদের বিষয়ে দুদক থেকে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। জড়িতরা যত বড় শক্তিশালীই হোক, তাদের আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে চায় কমিশন।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য যুগান্তরকে বলেন, টাকা পাচার বন্ধে টেকনিক্যাল নয়, রাজনৈতিক সমাধান জরুরি। তার মতে, বাংলাদেশে টাকা পাচারের বিরুদ্ধে আইনের কোনো ঘাটতি নেই। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক, আর্থিক ও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাও আছে।

কিন্তু রাজনৈতিক উৎসাহের অভাবে এগুলো কার্যকর হয় না। তবে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশ এলে, এগুলো দ্রুত কার্যকর হয়। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাসিনোসহ অন্যান্য দুর্নীতি উৎঘাটনের ক্ষেত্রে শিক্ষা পেয়েছি, সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরে এ কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা ও টেকসই হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে। দ্বিতীয়ত, টাকা বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কারণ হল দেশের উচ্চপর্যায়ের মানুষগুলো বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতে বিশ্বাস করেন না।

বিশেষ করে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো থেকে যারা সুবিধা নিয়েছেন, তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ওপর আস্থা রাখেন না। এছাড়া অনেকের আয় আইন ও বিধিসম্মত নয়। এজন্য তারা টাকা বিদেশে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন। কারণ তারা এ দেশে টাকা রাখা নিরাপদ বোধ করেন না।

এদিকে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্কের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে বছরে ৬ হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকি দিচ্ছে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি ও ব্যক্তি। যা মোট কর রাজস্বের সাড়ে ৩ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়ের ৬২ শতাংশের সমান। এ টাকা কম করের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান যুগান্তরকে বলেন, মন্ত্রী যাদের কথা বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের অর্থ পাচারের কোনো তালিকা এখনও আমাদের কাছে আসেনি। তবে আমরা কাজ করছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদের কাছে কোনো তথ্য চাইলে তা দিয়ে সহায়তা করা হচ্ছে।

পাশাপাশি টাকা পাচার বন্ধ ও বিদেশে টাকা ফিরিয়ে আনার জন্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে একটি কৌশলপত্র তৈরি হচ্ছে। ইতোমধ্যে এর কাজ কিছুটা এগিয়েছে। তার মতে, পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনা একক কোনো সংস্থার কাজ নয়। এর সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস এবং অন্যান্য সংস্থা জড়িত। সবাই যার যার জায়গা থেকে কাজ করছেন।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সবার আগে চিহ্নিত করতে হবে, টাকা পাচারকারী এ সরকারি কর্মকর্তা কারা। এরপর কীভাবে পাচার করা হল এবং এর সঙ্গে কারা জড়িত তাদের বিচার করতে হবে। তিনি বলেন, ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তারা টাকায় আয় করছেন।

পরবর্তীতে এগুলো বিদেশে পাচার করা হয়। এছাড়াও বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিংয়ের এবং চোরাচালানের সঙ্গে তারা জড়িত থাকতে পারে। বিষয়টি চিহ্নিত করার জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। তার মতে, বিদেশে টাকা গেলে ফিরিয়ে আনা খুবই কঠিন। ফলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) মার্চে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশ থেকে অস্বাভাবিক হারে টাকা পাচার বেড়েছে। ২০১৫ সালে ৯৮ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে ৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। জিএফআইর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২টি প্রক্রিয়ায় এ অর্থ পাচার হয়েছে।

এর মধ্যে রয়েছে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রফতানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডি ও বিওআইপি ব্যবসা। জিএফআইর তথ্য মতে, গত ৭ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ হাজার ২৭০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা।

প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। এছাড়া অর্থ পাচারে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ১৯ শতাংশই কোনো না কোনো ভাবেই পাচার হচ্ছে। এছাড়াও সুইস ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিএজে প্রকাশিত পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্সেও টাকা পাচারের তথ্য এসেছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়ার সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত দেশটির সেকেন্ড হোমে বাংলাদেশির সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। কানাডায় বাংলাদেশিরা বেগমপাড়া গড়ে তুলেছেন


শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published.