ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমঃ জলাভূমিতে উদ্ভিদ, প্রাণী ও গাছপালার অপরূপ সৌন্দর্য দৃশ্যমান। জলাভূমির পানি ফ্রেশ, লবণাক্ত অথবা দু’য়ের মাঝামাঝি হতে পারে। পুকুর, নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, সাগর ও নিম্নাঞ্চলগুলো জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত। জলাভূমি সংরক্ষণের জন্য ১৯৭১ সালে ‘রামসর কনভেনশনের’ যাত্রা শুরু হয়েছিল।
২০১৯ সাল পর্যন্ত রামসর কনভেনশনে স্বাক্ষরিত দেশের সংখ্যা ১৭১। বাংলাদেশ ১৯৯২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রামসর কনভেনশনে স্বাক্ষরিত দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। পরিবেশ সংরক্ষণে কমপক্ষে একটি জলাভূমি আন্তর্জাতিকভাবে তালিকাভুক্তির বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশ রামসরের অন্যতম স্বাক্ষরিত রাষ্ট্র। ওই শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ও টাঙ্গুয়ার হাওর রামসরে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব বিবেচনায় সিলেটের হাকালুকি হাওরও ভবিষ্যতে রামসরে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে প্রস্তাবিত রয়েছে।
রামসর সচিবালয়ের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, সমগ্র বিশ্বে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ৩৯৫টি জলাভূমি কনভেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ওই তালিকাভুক্তিতে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন হেক্টর জলাভূমি রয়েছে। রামসর দ্বারা চিহ্নিত বাংলাদেশে মোট জলাভূমির পরিমাণ প্রায় ৬,১১,২০০ হেক্টর। রামসর কর্তৃক চিহ্নিত ছাড়াও বাংলাদেশে প্রায় ৭ মিলিয়ন হেক্টর জলাভূমি রয়েছে, যা পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। যদিও সাগর, ইস্টোয়ারিন ও লেগুনা জলাভূমির পানি অনেকটা লবণাক্ত। আবার নদী, বিল ও হাওরকে বিশুদ্ধ পানির জলাভূমিও বলা হয়। পুকুর, খাল ও ছোট নালাগুলো মানবসৃষ্ট জলাভূমি নামে পরিচিত।
যা হোক, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে মানবসৃষ্ট গ্রিন হাউস গ্যাসই দায়ী। জলীয় বাষ্প, কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, ওজোন, নাইট্রাস অক্সাইড ও ক্লোরোফ্লোরোকার্বন (সিএফসি) গ্রিন হাউস গ্যাস নামে পরিচিত। বায়ুমণ্ডলে নির্গত ওই গ্রিন হাউস গ্যাসের ৮০ শতাংশ কার্বন ডাই অক্সাইড, ১০ শতাংশ মিথেন, ৭ শতাংশ নাইট্রাস অক্সাইড ও বাকি ৩ শতাংশ অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাস। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণ এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, বিগত ১০০ বছরে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে কার্বন ডাই অক্সাইডের অবদান শীর্ষে।
শতাংশের হিসাবে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইডে প্রায় ৩৪ শতাংশ পরিবহন, ৩২ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন, ১৫ শতাংশ শিল্প-কারখানা ও বাকি ৭ শতাংশ অন্যান্য উৎস থেকে বায়ুমণ্ডলে যোগ হচ্ছে। ১৭৫০ সালে শিল্পবিপ্লবের পর বায়ুমণ্ডলে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত কার্বন ডাই অক্সাইড, বৈশ্বিক উষ্ণতা লাগামহীনভাবে বাড়িয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, গ্রিন হাউস গ্যাস মিথেন, কার্বন ডাই অক্সাইডের তুলনায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ২৫ গুণ বেশি শক্তিশালী। যদিও বায়ুমণ্ডলে মিথেনের লাইফ টাইম কার্বন ডাই অক্সাইডের তুলনায় কম।
গবেষণায় আরও দেখা যাচ্ছে, মানবজাতি কর্তৃক প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি মিথেন বায়ুমণ্ডলে যোগ হচ্ছে। কৃষিতে অসুপারিশকৃত রাসায়নিক সারের প্রয়োগ, কেমিক্যাল উৎপাদন, ফুয়েল কনজাম্পশন, শিল্প-কারখানা ও অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।
উদ্ভিদ, প্রাণী ও মাইক্রোব্সে বিদ্যমান নাইট্রোজেন সাইকেলটিও প্রাকৃতিকভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নাইট্রাস অক্সাইডের নির্গমন বায়ুমণ্ডলে বাড়িয়েই দিচ্ছে। রেফ্রিজারেটরে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাস সিএফসি, ওজোন মোলিকুলকে ভেঙে অক্সিজেনের লম্বা চেইন তৈরি করায় সৃষ্ট ওজোনহোলের মাধ্যমে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীর পৃষ্ঠে পতিত হওয়ায় মানুষের শরীরে অনাকাঙ্ক্ষিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাচ্ছে। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনে বৈশ্বিক উষ্ণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
ভূমি সাধারণত কৃষি ফসল, গাছপালা, পানি, বসতভিটা ও বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ দ্বারা আবৃত থাকে। আবার কিছু ভূমি দীর্ঘদিন ধরে পতিতও দেখা যায়। ওইসব প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে ভারসাম্য থাকায় পৃথিবীতে বসবাসরত মানবজাতি সরাসরি উপকৃত হচ্ছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ‘ল্যান্ড ইউজ ল্যান্ড কভার’ এ বিদ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদের ভারসাম্যহীনতা ক্রমাগত বেড়েই চলছে।
যদিও বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবেলায় প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে বিস্তীর্ণ জলাভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। জলাভূমিতে বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ, প্রাণী ও গাছপালা ছাড়াও সেডিমেন্টের বিস্তীর্ণতা রয়েছে; যা কার্বন স্টোরেজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জলাভূমিতে দৃশ্যমান গাছপালা কর্তৃক বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে সালোকসংশ্লেষণ পদ্ধতিতে খাদ্য উৎপাদন করায় বায়ুমণ্ডলে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাস কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করছে।
যাহোক, জলাভূমিগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কার্বন রির্জারভার হিসেবে স্বীকৃত। জলাভূমিতে পৃথিবীর প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ টেরিস্ট্রিয়াল কার্বন জমা রয়েছে। যদি কোনো কারণে জলাভূমিগুলোর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, জলাভূমি কার্বন সিঙ্ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবেলায় জলাভূমি কর্তৃক প্রায় ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
যদিও বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনে জলাভূমি মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে; তবুও বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে জলাভূমিতে বিদ্যমান ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ও অন্যান্য উদ্ভিদগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও টেকসই উন্নয়নের আশাবাদ ব্যক্ত করা যেতে পারে।
বাস্তব চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, জলাশয়গুলো ভরাটে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যদিও বর্ধিত জনসংখ্যার বাসস্থান ও খাদ্য চাহিদা পূরণে অতিরিক্ত জায়গার প্রয়োজন; তবুও মানবজাতির সুস্বাস্থ্য ও টেকসই উন্নয়নে জলাভূমি সংরক্ষণের গুরুত্বকে অগ্রাধিকার দিয়েই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আবার প্রাকৃতিক জলাশয়ে কৃত্রিমভাবে মাছচাষে জলাভূমিতে বিদ্যমান ইকোসিস্টেমের ভারসাম্যহীনতায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টিও উড়িয়ে দেয়া যায় না। অন্যদিকে অপরিকল্পিতভাবে উৎপাদিত বর্জ্যও শহরের জলাভূমিতে অহরহ ফেলা হচ্ছে। এর ফলে জলাশয়ে বিদ্যমান মাটি, পানি ও বায়ুদূষণের মাত্রাও লাগামহীনভাবে বেড়ে যাচ্ছে।
যাহোক, বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বের অন্য একটি দেশের জলাভূমি সংরক্ষণের ওপর দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে। ফিলিপাইনে সরকার অনুমোদিত ‘দি ডিপার্টমেন্ট অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস’ প্রতিষ্ঠানটি জলাভূমিতে বিদ্যমান জৈববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অবিরত কাজ করে যাচ্ছে। উক্ত প্রতিষ্ঠানটি সমগ্র ফিলিপাইনে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরিবেশ সংরক্ষণে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, এনজিও ও সরকারি ব্যক্তিরা জলাভূমি সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছেন; তবুও পরিবেশ সংরক্ষণে জলাভূমি সংরক্ষণের ওপর আরও বেশি দায়িত্বশীল হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
জলাভূমির গুরুত্ব বিবেচনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ হাওর-বাঁওড়, নদী-নালা ও বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে ভরপুর। জলাভূমিতে বিদ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে হাওর উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে জাতির পিতার মৃত্যুর পর আজ পর্যন্ত কোনো সরকার হাওর ও জলাভূমির উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তিনি হাওর ও দেশে বিদ্যমান অন্যান্য জলাভূমির উন্নয়নে একটি মাস্টারপ্ল্যান গঠনসহ প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ সংরক্ষণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে হাওরের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে ও পরিবেশের উন্নয়নে বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবেলায় সুনামগঞ্জে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ খাদ্যে যেমন স্বয়ংসম্পূর্ণ, তেমনি জলাভূমি সংরক্ষণের মাধ্যমে পরিবেশ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ব্যাপারেও অঙ্গীকারবদ্ধ।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা গতিশীল রাখার জন্য দেশের সবাইকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নিজের অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। উদ্যোক্তাদেরও বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে জলাভূমি সংরক্ষণের গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়েই নগরায়ণ ও শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করতে হবে।
আশা করা যাচ্ছে, বিস্তীর্ণ জলাভূমির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণসহ প্রাকৃতিক সম্পদের ভারসাম্য ঠিক থাকবে। যেহেতু বাংলাদেশ জলাভূমির দেশ, সেহেতু জলাভূমি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ‘জলাভূমি গবেষণা প্রতিষ্ঠান’ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, যেটি বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জলাভূমির অবদানের ওপর গবেষণা অব্যাহত রাখবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম : সহযোগী অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর৷ সূত্রঃ যুগান্তর