হাসিনা আমলে ‘সুবিধাভোগী’ বিএনপি নেতারাই সুরক্ষা কবচ সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নানের
ছাত্র আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে স্বৈরাচার তকমা পাওয়া শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালানোর পর জায়গায় জায়গায় গণরোষে পড়েছেন তার সরকারের মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে দলের নেতা, পাতি নেতারা। তবে সুনামগঞ্জ-৩ আসনের চার মেয়াদের এমপি (তিনবার বিতর্কিত ভোটে) ও সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের ওপর এই গণরোষের আঁচও লাগেনি। নির্বিঘ্নেই শান্তিগঞ্জের ‘হিজলবাড়িতে’ অবস্থান করেছেন তিনি।
জানা গেছে, ক্ষমতায় থাকাকালীন তার কাছ থেকে সুবিধা পাওয়া বিএনপির নেতারা এখন মান্নানের সুরক্ষা কবচ হয়ে আগলে রেখছেন। উল্টো সাবেক এই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলায় নিজে দিলের কর্মী ও সাংবাদিককে মারধর করতেও দ্বিধা করেননি মান্নান আমলে ‘শান্তিতে’ থাকা বিএনপি নেতারা।
জানা যায়, বিএনপি একাংশের কাছে একইভাবে সুরক্ষা পাচ্ছেন মান্নানের ঘনিষ্ট সহযোগী দুই ভাই হাসনাত ও নূর হোসেন এবং তার ভাগ্নে জাবেদসহ অন্যরা। মন্ত্রীর মদদপুষ্ট হয়ে সুনামগঞ্জে দুর্নীতির বরপুত্র হয়ে ওঠা ভ্রাতৃদ্বয়কে ক্ষোভে সাধারণ মানুষ নাম দিয়েছিলেন ‘হাবিল-কাবিল’ হিসেবে। উন্নয়ন প্রকল্প থেকে বখরা, টিআর-কাবিখা-কাবিটা ভাগ বসানো এবং হাওর বাঁধের ভাগবণ্টন সবখানেই হাত ছিল দুই সহোদরের। তাদের সহযোগী ছিলেন মন্ত্রীর ভাগ্না জাবেদ, ভাতিজা সুজন প্রমুখ।
বিএনপির দলীয় সূত্র জানায়, শান্তিগঞ্জ উপজেলায় বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে দ্বিধাবিভক্ত। একাংশের নেতৃত্বে আছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ, অপর অংশের নেতৃত্বে জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আনসার উদ্দিন। চলতি মেয়াদের আগের মেয়াদে উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন ফারুক। নির্বাচন করায় দল থেকে বহিষ্কার হলেও তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের ‘ফেভার’ পেয়ে পূর্ণ মেয়াদে নির্বিঘ্নে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সে সময়ে সুবিধাভোগী বিএনপির সাবেক চেয়ারম্যান আমিনুর রশিদ আমিনও রয়েছেন তার সুরক্ষায়।।
এর বিপরীতে শান্তিগঞ্জ উপজেলা বিএনপির অপরাংশের নেতৃত্বে থাকা আনসার উদ্দিন ছিলেন মন্ত্রীর রোষানলে। সরকারবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রতিটি মামলায় আসামি করা হতো তাকে। কোমরে রশি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হতো আদালতে।
সূত্র আরো জানায়, হাসিনার পদত্যাগের একদিন পর শান্তিগঞ্জে বিজয় মিছিলের আয়োজন করেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুকপন্থী বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এ সময় বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙচুর করলেও সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রীর বাড়ির সম্মুখে বিএনপি নেতা জিলানীর নেতৃত্বে পাহারা বসান ছাত্রদলের নেতারা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এই দৃশ্য দেখে বিক্ষুব্ধ এক ছাত্রদলকর্মী মান্নানের সমালোচনা করলে, উপস্থিত বিএনপি ও ছাত্রদল নেতারা তাকে মারধর শুরু করেন। এসময় ঘটনাস্থলের অদূরে থাকা সাংবাদিক শহীদনূর এগিয়ে গিয়ে মারধরের কারণ জানার পর বলেন, তিনি (মান্নান) তো আর ফেরেশতা ছিলেন না। এই মন্তব্য করতে না করতেই বিএনপির মিছিলে আসা মান্নানের শুভাকাঙ্ক্ষী ছাত্রদল-যুবদলের নেতারা তাকে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন। পরে অন্যান্য গণমাধ্যমকর্মীরা তাকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান।
প্রসঙ্গত, শহীদনূর আহমেদ আরটিভি ও দৈনিক ‘সিলেটের ডাক’-এর সুনামগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি। ক্ষমতায় থাকাকালীন মান্নানের বিরুদ্ধে নানা ইস্যুতে সরব ছিলেন তিনি। পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন।
পরে গুরুতর আহত শহীদনূরকে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তির পর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম নূরুলসহ বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা হাসপাতালে তাকে দেখতে আসেন।
এ সময় নূরুল বলেন, দলীয় ব্যানার ব্যবহার করে কেউ স্বৈরাচারের দোসরদের রক্ষা করতে চাইলে তাদের চিহ্নিত করা হবে। আমরা সবার আমলনামা জানি। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
শান্তিগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ বলেন, আমি মান্নান সাহেবের কোনো ফেবার পাইনি। যে অভিযোগ ওঠেছে সেটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বরং তিনি মন্ত্রী থাকাকালে তার লোকজনের কারণে দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয়েছি।
জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আনসার উদ্দিন বলেন, দলের ভেতরে কিছু মানুষ আছে যারা বিগত সরকারের কাছ থেকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা নিয়েছে। এখন তাদের রক্ষা করে তার প্রতিদান দিচ্ছেন তারা। এটা দুঃখজনক।
মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের বক্তব্য এই প্রতিবেদনে সংযুক্ত করা সম্ভব হয়নি।