অনলাইন ডেস্কঃ ভাইরাস ও ছত্রাকের আক্রমণ শনাক্তে রোগীর মস্তিষ্কের রস সংগ্রহে ব্যবহৃত হয় বিশেষ ধরনের এক সুই। দেশের বাজারে যার প্রতিটির মূল্য ২৫০ টাকা। অথচ এই সুচই প্রতিটি ২৫ হাজার টাকায় কিনেছে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতিষ্ঠান রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ। টাকার অঙ্কে যা বাজারদরের চেয়ে গুনে গুনে ১০০ গুণ বেশি। আর শুধু সুচই নয়, এমন অস্বাভাবিক দামে ঠিকাদারদের কাছ থেকে আরও বেশ কিছু এমএসআর (মেডিকেল সার্জিক্যাল রিকুজিটি) পণ্য কিনেছে সরকারের এই স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানটি। এমন দামে যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনা হয়েছে, যা পৃথিবীর কোথাও এ দামে বিক্রি হয় না।
অস্ত্রোপচারের সময় চামড়া আটকে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয় একধরনের বিশেষ যন্ত্র, যার নাম টিস্যু ফরসেপস। দেশের বাজারে যা প্রতিটি পাওয়া যায় মাত্র ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে। কিন্তু এটি কেনা হয়েছে প্রতিটি ২০ হাজার টাকায়। রোগীর প্রস্রাব ধরে রাখার ইউরিনারি ব্যাগের প্রতিটির বাজারমূল্য ৬০ টাকা, কিন্তু এই ব্যাগই প্রতিটি কেনা হয়েছে ১ হাজার ৩০০ টাকায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মাত্র এক মাসে এই কেনাকাটা করেছে নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ছয় কোটি টাকার এমএসআর পণ্য অস্বাভাবিক দরে কেনাকাটার তথ্য পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে ২০১৯ সালে তদন্ত কমিটি করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, তবে কেউ শাস্তি পায়নি আজও।
এভাবে অস্বাভাবিক দামে পণ্য কেনাকাটার বিষয়ে বক্তব্য জানতে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে এই প্রতিবেদক ব্যর্থ হন। এরপর তার মোবাইল ফোনে ও হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এসএমএস পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
অস্বাভাবিক দামে পণ্য কেনাকাটার কারণ জানতে চাইলে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক চিকিৎসক ফারুক আহমেদ গতকাল শনিবার মোবাইল ফোনে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার জানা নেই। কারণ এ ঘটনার পরে আমি এখানে জয়েন করেছি।’
নিউরো সায়েন্স হাসপাতাল গড়ে মাসে ১০ থেকে ১১ কোটি টাকার এমএসআর পণ্য কেনাকাটা করে থাকে। বছরে প্রতিষ্ঠানটি ১৩০ কোটি টাকার বেশি কেনাকাটা করে। যার বড় অংশেই এমন সাগর চুরি হয় বলে সংশ্লিষ্টদের মত। আর সারা দেশে স্বাস্থ্য ও সেবা বিভাগের এই খাতে গত অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দ ছিল প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।
শুধু নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতাল নয়, দেশের বড় সরকারি হাসপাতালগুলোয় প্রতি মাসেই বড় অঙ্কের টাকার এমএসআর পণ্য কেনা হয়। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত অর্থবছরে ৬৮ কোটি টাকার এমএসআর পণ্য কেনায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে ‘ভিক্টর ট্রেডিং করপোরেশন’ এবং ‘এবি ট্রেডিং করপোরেশন’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোট ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকার বেশি এমএসআর পণ্য কিনেছে নিউরো সায়েন্সেস কর্র্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ভিক্টর ট্রেডিংয়ের কাছ থেকে ৩ কোটি ৫৭ লাখ ৭৭ হাজার ৮৫০ টাকার এবং এবি ট্রেডিংয়ের কাছ থেকে ২ কোটি ৭৩ লাখ ১৩ হাজার ৬৫০ টাকার এমএসআর পণ্য কেনা হয়েছে।
নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালের দুজন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তিনজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, শুধু নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালে বছরে এমএসআর পণ্য কেনা হয় ১০০ কোটি টাকার ওপরে। দেশের সব বড় সরকারি হাসপাতাল প্রতি মাসে এমএসআর পণ্য কিনে থাকে। আর এর প্রতিটির কেনাকাটায় ভয়াবহ দুর্নীতি হয়। এটা ‘ওপেন সিক্রেট’। মন্ত্রণালয়ের ‘মহাপরাক্রমশালী’ একটা সিন্ডিকেট আছে। তারাই এই কারবার ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। বাস্তবে এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই বলে তাদের দাবি।
লাগামছাড়া দামে কেনাকাটা : স্বাস্থ্য বিভাগের সিন্ডিকেটটি এমএসআর পণ্যের দামের ক্ষেত্রে অপ্রচলিত বা কম ব্যাবহার হয়Ñ এমন পণ্যকে টার্গেট করে থাকে। এ ধরনের পণ্য সাধারণত বিশেষায়িত হাসপাতালে বেশি ব্যবহার হয়। অপ্রচলিত এসব এমএসআর পণ্যের দাম বাজারমূল্যের চেয়ে শত গুণ বেশি রাখে। আর মোট কেনাকাটার বরাদ্দের সিংহভাগ অর্থ এসব পণ্য কিনতেই ব্যয় করা হয়। নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
এবি ট্রেডিং করপোরেশন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ডায়াবেটিসের রোগীর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরিমাপের জন্য যে স্টিপ ব্যবহার হয় তার দাম রেখেছে প্রতিটি ২৮ টাকা। সাধারণত বাজারে খুচরা ক্রেতারা এই স্টিপ প্রতিটি ১০-১২ টাকায় কিনে থাকেন (এক বক্স কিনলে প্রতিটির দাম এমন পড়ে)। আর এর সুচ ২০-২৫ পয়সায় কিনে থাকেন ক্রেতারা, কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেই সুইয়ের মূল্য ধরেছে প্রতিটি ২ টাকা। এসব বহুল ব্যবহৃত পণ্যে লাভ করলেও গলাকাটা লাভ করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রচলিত এসব পণ্যের কেনাকাটার অঙ্কও খুব বেশি ছিল না। কার্যাদেশ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এবি ট্রেডিং করপোরেশনের সরবরাহ করা ২ কোটি ৭৩ লাখ টাকার পণ্যের মধ্যে সব থেকে বেশি কেনা হয়েছে লাম্বার ড্রেনেজ সিস্টেম। রোগীর মস্তিষ্ক থেকে রস সংগ্রহ করা হয় একধরনের সুইয়ের মাধ্যমে, যাকে লাম্বার ড্রেনেজ বলে। সাধারণত ভাইরাস ও ছত্রাকের আক্রমণ শনাক্ত করা যায় এ পরীক্ষার মাধ্যমে। এ ছাড়া রোগীর মস্তিষ্কের প্রেসারও নির্ণয় করা যায়। এ ধরনের একটি সুইয়ের বাজারমূল্য ব্যাগসহ ২৫০ টাকা। অথচ নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতাল এটি কিনেছে প্রতিটি ২৫ হাজার টাকায়। প্রতিটি ইভিডি সেটের বাজারমূল্য ৩০০ টাকা, কেনা হয়েছে ১৬ হাজার টাকায়। এটি কিনেছে ২০৬ সেট, প্রতি সেটের দাম ২৫ হাজার টাকা করে মোট টাকার পরিমাণ ছিল ৫১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এই ২০৬ সেটের প্রকৃত বাজারমূল্য ৫১ হাজার ৫০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে একটি পণ্যেই প্রায় ৫১ লাখ টাকা মুনাফা করা হয়েছে।
রোগীর মূত্রনালিতে ব্যবহারের ব্যাগের বাজারমূল্য প্রতিটি ৪৫ টাকা, কেনা হয়েছে ১ হাজার ৩০০ টাকায়। প্রধান ধমনির জন্য ব্যবহৃত প্রতিটি ক্যানুলার বাজারমূল্য ৮০ টাকা, কেনা হয়েছে ১ হাজার ৪০০ টাকায়। রক্তের ব্যাগ থেকে রক্ত নেওয়ার টিউবসহ একটি কাঠামো, যার নাম ব্লাড ট্রান্সফিউশন সেট, এটির বাজারমূল্য প্রতিটি ২২ টাকা। অথচ প্রতিটি কেনা হয়েছে ৯৫ টাকায়। একই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রতিটি বাঁকানো কাঁচি (ফাইন কার্ভড সিজর) কেনা হয়েছে ১০ হাজার ৫০০ টাকায়, অথচ বাজারে এর দাম মাত্র ৪০০ টাকা। বাঁকানো কাঁচি কেনা হয়েছে মোট ১০ লাখ ৫ হাজার টাকার। মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারের সময় একধরনের আঠা ব্যবহার হয়, যার নাম অ্যাডহেসিব ড্রাপার। বাজারে প্রতি পিস এমন আঠার দাম ৭০০ টাকা, কেনা হয়েছে ১ হাজার ৯৮০ টাকায়। মোট ৩৯ লাখ ৬০ হাজার টাকার আঠা কেনা হয়েছে। ক্যানসারজাতীয় রোগ আছে কি না, তা পরীক্ষার জন্য শরীর থেকে টিউবের মাধ্যমে টিস্যু নেওয়া হয়, যার নাম মাইক্রোবুনেট সেট। এর একটি সেটের বাজারমূল্য ৬০-৭০ টাকা। কেনা হয়েছে ১ হাজার ৫০ টাকায়। মোট ২ হাজার ৯০০ সেট কেনা হয়েছে ৩০ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়।
অণুবীক্ষণ যন্ত্র যখন কেনা হয়, তখন যন্ত্রের মুখের সামনে ঢাকনাসহই কেনা হয়। কিন্তু নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতাল নতুন করে ৬০০ অণুুবীক্ষণ যন্ত্রের ঢাকনা কিনেছে। প্রতিটি প্লাস্টিকের ঢাকনা কিনেছে ১ হাজার ৭৯০ টাকায়, আর এর জন্য মোট ব্যয় হয়েছে ১০ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। রাজধানীর তোপখানা ও শাহবাগের মেডিকেল পণ্য বেচাকেনার মার্কেট ঘুরে জানা গেছে, বাস্তবের দামের চেয়ে নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালের এসব কেনাকাটা হয়েছে অনেক বেশি দামে। কোথাও কোথাও মূল দামের চেয়ে পার্থক্য ১০০ গুণ বেশি।
ভুয়া ঠিকাদার : নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষের কার্যাদেশ ও নথিপত্রে ভিক্টর ট্রেডিং করপোরেশনের ঠিকানা উল্লেখ ছিল রাজধানীর ৪৮২/১ শেরেবাংলা নগর। ওই ঠিকানায় গিয়ে এ রকম কোনো প্রতিষ্ঠানকে পাওয়া যায়নি। আর এবি ট্রেডিং করপোরেশনের ঠিকানা দেওয়া ছিল বাড়ি নম্বর ২৮৪/২৮৫, রোড নম্বর-২, বায়তুল আমান হাউজিং, আদাবর। সেটি আবাসিক ভবন, সেখানে গিয়েও মেলেনি এমন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম।
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারীরা বলছেন, এসব বানোয়াট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই বিভাগের প্রভাবশালী ব্যক্তির ঘনিষ্ঠজনদের। তারা শুধু কেনাকাটার কার্যাদেশটা নিয়ে আসে। এরপর ঢাকার বিভিন্ন সাপ্লাইয়াররা চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে আসেন। মাঝখান থেকে মোটা টাকা তারা নিয়ে নেয়। এমনকি তারা কী পণ্য দিল, সেটাও জানে না। এসব বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞানও নেই।
এ প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ভোক্তা অধিকার নাগরিক সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে অস্বাভাবিক দামে কেনাকাটা ও দুর্নীতি রয়েছে, এটা নতুন করে বলার কিছু নেই। এটি দেখার কথা সরকারের হিসাব মহানিয়ন্ত্রক (সিজিএ) কর্র্তৃপক্ষের। এ ধরনের অস্বাভাবিক কেনাকাটার তথ্য প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। সিজিএর উচিত হবে স্বাস্থ্য খাতের এ ধরনের কেনাকাটা নিয়ে দ্রুত একটি বিশেষ অডিট করা এবং প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করা।’
সূত্রঃ দৈনিক দেশ রুপান্তর