সোহেল সানি : বাংলাদেশে শুধু নয়, ভারত উপমহাদেশেই নারীদের ভোটাধিকার ছিল না, ১৯২৬ সালের আগে। নারীর গণপ্রতিনিধি হওয়া তো দূরের কথা। অথচ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশ শাসিত হচ্ছে নারী নেতৃত্বে।
উল্লেখ্য,বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করে ২০২১ সালে। স্বাধীনতার ৫২ বছরের মধ্যে ৩০ বছরই দেশ শাসনভার নারীর হাতে। বঙ্গবন্ধু ও জিয়া হত্যাকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশে রাজনীতিতে উত্থান ঘটে দুই নারীর।
অন্যান্য মহাদেশের মতো এশিয়াতেও শাসনভার চলে যায় নারীর হাতে। ভারতে ইন্দিরা গান্ধী, পাকিস্তানে বেনজীর ভুট্টো, বাংলাদেশে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা।
দেখা যায়, স্বাধীনতার ৫২ বছরে দুইজন নারী ও ১৩ জন পুরুষ বাংলাদেশ শাসন করেছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা ইতিমধ্যেই পার করেছেন প্রায় সাড়ে ১৯ বছর বর্তমান মেয়াদ শাসনক্ষমতায় তাঁর দুই দশক পূর্ণ হবে।
দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসীন হয়। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে পরাজয়ের পর আবারও বিরোধী দলে চলে যায় আওয়ামী লীগ। ২০০৯ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদেই আওয়ামী লীগের বিজয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা।
অপরদিকে ১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১- ২০০৬ এই মোট ১০ বছর দেশ শাসন করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু সাড়ে তিন বছর, জিয়া পৌনে পাঁচ বছর এবং এরশাদ ৯ বছর দেশ শাসন করেন।
বাকী সময় বিচ্ছিন্নভাবে দেশ শাসিত হয়। জিয়ার শাসনামলের শেষ দিকে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা ও এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৪ সালে বিএনপিতে উত্থান ঘটে বেগম খালেদা জিয়ার। দুটি দলেরই নেতৃত্বের চরম সংকটের মুখে তাদের উত্থান। আবদুল মালেক উকিলকে সরিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে।
অপরদিকে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সরিয়ে বিএনপির চেয়ারপার্সন নির্বাচিত করা হয় জিয়া পতœী খালেদা জিয়াকে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হবার ৩ বছর পর ১৯৮৪ সালে।
শেখ হাসিনার বর্তমান মেয়াদ পূর্ণ হলে স্বাধীনতার ৫২ বছরের মধ্যে নারীর শাসনই হবে ৩০ বছর।
৩০ বছরের এই শাসনামলের ২০ বছর শেখ হাসিনার আর ১০ বছর খালেদা জিয়ার। অর্থাৎ নেতৃত্বে নারীর সংখ্যা দুই। আর পুরুষের সংখ্যাটা ১৩।
এদের মধ্যে ১১ জনই শাসক হিসাবে সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত হয়েছেন।
প্রসঙ্গত,পুরুষই পুরুষকে নেতৃত্ব হতে বিতাড়িত করেছে। এজন্য নারী আন্দোলনের ফল ছিল না।
নারী শাসিত দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
তৃতীয় দল জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের নেতাও একজন নারী রওশন এরশাদ। এরশাদের জীবদ্দশায়ই তার পত্নী রওশন এরশাদ বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁরই নির্দেশিত পথে
সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে ক্রমে রাষ্ট্রশাসন ক্ষমতা পরিচালনা করেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, বিচারপতি আবু সা’দত মোহাম্মাদ সায়েম, জেনারেল জিয়াউর রহমান, বিচারপতি আব্দুস সাত্তার, বিচারপতি আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসান উদ্দীন চৌধুরী ও হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ।
১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন হলে তিন জোটের ঐতিহাসিক রূপরেখার ভিত্তিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। শুধুমাত্র একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নিবার্চনের বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ্য দল হিসাবে জামাতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া প্রথম নারী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন। বিরোধী দলের নেতা হন শেখ হাসিনা।
তীব্র আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকারের পতন ঘটলে ১৯৯৬ সালে বিচারপতি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর সমমর্যাদায় তিনি প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সংসদ নির্বাচন আয়োজন করেন। ২৩ জুন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন খালেদা জিয়া। সাংবিধানিকভাবে ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। পহেলা অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি- জামাত জোট সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী এবং শেখ হাসিনা সংসদের বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালের শেষদিকে প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ নিয়ে চরম রাজনৈতিক সংকট দেখা দিলে রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দীন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টা হন। কিন্তু রাজনৈতিক সংকট সংহিতায় রূপ নিলে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে। ডঃ ফখরুদ্দীন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টা পদে আসীন হন। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া কারারুদ্ধ হন। তাদের মুক্তি আন্দোলন জোরদার হতে থাকলে সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকার ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচন দেয়। ওই নির্বাচনে মহাজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। খালেদা জিয়া বিরোধী দলের নেতা হন। সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়। বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে। সর্বশেষ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও রায় প্রত্যাখ্যান করে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া একটি দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামী হিসাবে দীর্ঘদিন কারাবন্দী শেষে এখন সার্বক্ষনিক নিজ গৃহে অবস্থান করছেন।
উল্লেখ্য, ১৯০৩ সালে চরম আন্দোলনের মুখে প্রথম নারীরা ভোটাধিকার অর্জন করে। আর ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে নারীরা ভোটাধিকার লাভ করে এর ২৩ বছর পর ১৯২৬ সালে।
এ জন্য নারীদের জেল, জুলুম, নিপীড়ন ও নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়। বিশ শতকের পূর্বে কোন দেশেই নারীর ভোটাধিকার ছিল না।
আধুনিক গণতন্ত্রেও নারীরা ছিল অধিকার বঞ্চিত। খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, ইহুদি ও হিন্দু ধর্মে নারীর অধঃস্তন অবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেয়। ১৭ শতকে নারীরা ভোটের অধিকার আদায়ের আন্দোলন রচনা করে এবং বিশ শতক পর্যন্ত দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৯০৩ সালে কোন কোন দেশে নারীরা ভোটের অধিকার অর্জন করে।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।