রাহাদ সুমন,বানারীপাড়া(বরিশাল)প্রতিনিধি॥ স্ত্রীর গর্ভে সন্তান রেখে জুলাই গণঅভূত্থানে শহীদ হন বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের পূর্ব বেতাল গ্রামের আল-আমিন রনি। তার মৃত্যুর প্রায় চার মাস পরে ৪ নভেম্বর বানারীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে স্ত্রী মিম আক্তার এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। নবজাতকের নাম রাখা হয় “রোজা”। বাবা আল- আমিন রনি ও মেয়ে রোজার ভাগ্য যে কতটা নির্মম। রনি বাবা হয়েছেন ঠিকই কিন্তু সন্তানের মুখটা দেখতে পারলেন না। মেয়ে রোজাও উঠতে পারলো না বাবার কোলে,দেখতে পারলো না বাবার মুখ। পেল না বাবার অপার ¯েœহ-ভালোবাসা। প্রায় ৬ মাস বয়সী রোজার জীবনে এবারের প্রথম ঈদ কাটলো বাবাকে ছাড়া। সবার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে শিশু রোজা হয়তো ওর বাবাকেই খুঁেজ ফেরে। নির্মম বুলেট বাবাকে তার জন্মের আগেই না ফেরার দেশের যাত্রী করে দিয়েছে। রনিকে হারিয়ে তাদের গোটা পরিবারে এবারের ঈদের আনন্দ ভেসে গেছে চোখের জলে। রনিকে হারিয়ে তার মা মেরিনা বেগম ও শতবর্ষী দাদি মরিয়ম বেগমের কান্না-বিলাপ আজও থামেনি। ঘরের সামনে রনি’র কবরের কাছে গিয়ে তারা প্রতিদিনই চোখের জলে ভাসেন। তার জান্নাত কামনায় মহান আল্লাহর দরবারে হাত তুলে ফরিয়াদ করেন। মা মেরিনা বেগম কান্না করে বলেন,নাড়ী ছেড়া ধন রনি’র মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের সব হাসি-আনন্দ চিরতরে হারিয়ে গেছে। প্রতিবছর রনি পরিবারের সবার জন্য ঈদের পোশাক ও খাবারসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুই কিনতো,সবাইকে নিয়ে আনন্দে মতোয়ারা হয়ে ঈদ উদযাপন করতো। সেই বুকের মানিককে ছাড়া এবারের ঈদ কেটে গেছে তার কবরের কাছে গিয়ে চোখের জল ফেলে। তিনি আরও বলেন,ছেলেটার কত স্বপ্ন ছিল বাবা ডাক শুনবে। সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়িয়ে মানুষের মতো মানুষ করবে। আমার বুকের মানিকের এই স্বপ্ন আর পূরণ হইল না। সন্তানের মুখটা দেখা হল না। সবাইকে ছেড়ে চলে গেল আমার বুকের মানিক! বিয়ের এক বছর তিন মাসের মাথায় বিধবা হওয়া স্ত্রী মিম আক্তার জানান, ছেলে হলে আজান আর মেয়ে হলে রোজা নাম রাখার ইচ্ছে ছিলো স্বামী আল আমিন রনির। তার ইচ্ছে অনুযায়ী মেয়ের নাম রাখা হয় রোজা আক্তার। তবে স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই অথৈ সাগরে ভাসছেন তিনি। এখন নিজের পাশাপাশি সন্তানকে নিয়ে অসহায় বাবার পরিবারে বোঝা হতে চান না মিম। তিনি বলেন,স্বামীর সঙ্গে জীবনের সব আনন্দও হারিয়ে গেছে। বাবাহারা এই সন্তানকে বড় করে তোলা এখন জীবন যুদ্ধে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সন্তানের মাঝেই খুঁজে পাবো প্রিয় স্বামীর ছায়া। এবছর ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে নিজে সাবলম্বি হয়ে মেয়েকে মানুষের মত মানুষ করে তোলাই এখন জীবনের প্রধান লক্ষ্য। নিহত রনির শ্বশুর চাখার বাজারের ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ী মো. কামাল হোসেন মাঝি বলেন, ‘মিম এইচএসসি পাস করেছে। এবছর ডিগ্রিতে ভর্তি হবে। মেয়েকে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। প্রসঙ্গত,আল-আমিন রনি (২৪) গতবছরের ১৯ জুলাই ঢাকার মহাখালীতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পরদিন ২০ জুলাই তাঁর মরদেহ মা মেরিনা বেগমসহ স্বজনরা বাড়িতে নিয়ে আসেন। বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের পূর্ব বেতাল গ্রামে তাদের বাড়ি। আল-আমিন রনি মহাখালীর মাল্টিব্র্যান্ড ওয়ার্কশপে কাজ করতেন। বাবা দুলাল হাওলাদার মারা গেছেন করোনাকালে। মা মেরিনা বেগম, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মিম ও ছোট ভাই রহিমকে নিয়ে ঢাকার মহাখালী সাততলা বাউন্ডারি বস্তি এলাকায় থাকতেন রনি। রনির আয় দিয়ে চলত চার সদস্যের এই পরিবার। ঘটনার দিন ১৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মায়ের কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে মহাখালীর বস্তি এলাকার বাসা থেকে বের হন রনি। বিকেল ৫টার দিকে মহাখালী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সংঘর্ষের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। রাত ৮টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে তাঁর মরদেহ শনাক্ত করেন মা। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ ২০ জুলাই বানারীপাড়ার পূর্ব বেতাল গ্রামে এনে রাত ১টায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবার পাশে তার মরদেহ দাফন করা হয়।
