সোহেল হোসেন, লক্ষ্মীপুর থেকেঃ সয়াল্যান্ড হিসেবে খ্যাতি রয়েছে লক্ষ্মীপুর জেলার। মেঘনার উপকূলীয় এই জেলায় জলোচ্ছ্বাস ও অতিবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। এই কারণে সয়াবিন চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন কৃষকরা। গত পাঁচ বছরে ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে কমেছে সয়াবিন চাষ। সেখানে তারা বিকল্প হিসেবে ধান, ভুট্টা, ছোলার আবাদ করছেন।
তবে স্থানীয় কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, আবাদি জমি কমলেও সয়াবিন উৎপাদনে তেমন প্রভাব পড়বে না। চলতি বছর লক্ষ্মীপুরে উচ্চ ফলনশীল বিইউ-১, বিইউ-২, বারি-৫, ৬, বিনা-৫, ৬ জাতের সয়াবিনের আবাদ হয়েছে। এতে ফলন বাড়বে দুই থেকে তিনগুণ। চলতি বছর সয়াবিন থেকে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনার কথা জানান তরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে লক্ষ্মীপুর জেলায় ৫২ হাজার ৭২০ হেক্টর জমিতে সয়াবিনের আবাদ হয়েছিল। এসব জমিতে ১ লাখ ৩ হাজার ৩০ টন সয়াবিন উৎপাদন হয়। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরে আবাদ হয়েছে ৪০ হাজার ৮১০ হেক্টর জমিতে। ৫ বছরের ব্যবধানে সয়াবিন আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে ১১ হাজার ৯১০ হেক্টর। উৎপাদন কমেছে ২৫ হাজার ৪৯০ টন। চলতি বছর এসে আরও ২ হাজার ৮১০ হেক্টর জমির আবাদ কমেছে। তবে চলতি মৌসুমে পানিসহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল নতুন জাতের সয়াবিন বীজ চাষে এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। নতুন জাতে হেক্টরপ্রতি আড়াই থেকে সাড়ে ৩ টন উৎপাদন হওয়ার কথা জানায় কৃষি বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জেলার সবচেয়ে বেশি সয়াবিনের চাষ হয় রামগতি উপজেলায়। গত বছর রামগতিতে ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদ হয়। ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাব ও অতিবৃষ্টির কারণে উপজেলার বড়খেরী, রোগনাথপুর এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু জমির সয়াবিন নষ্ট হয়ে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অনেক কৃষক সয়াবিন চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। চলতি বছর ওই অঞ্চলে ১৪ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে সয়াবিনের আবাদ হয়েছে। এই মৌসুমে রায়পুর উপজেলায়ও সয়াবিনের আবাদ কমেছে ১ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে। গত বছর এ উপজেলায় ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিনের আবাদ হলেও এবার হয়েছে ৬ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে।
মেঘনার তীরবর্তী কমলনগর উপজেলায় এবার সয়াবিনের আবাদ হয়েছে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে। আবাদের বাইরে রয়ে গেছে ৫০০ হেক্টর জমি। তবে সয়াবিন আবাদের ৩০০ হেক্টর জমি বেড়েছে সদর উপজেলায়। ২০২০-২১ অর্থবছরে সদরে ৩ হাজার ২৭০ হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ হয়। চলতি বছর প্রায় ৩ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে আবাদ করেছেন চাষিরা। তবে সবচেয়ে কম সয়াবিন চাষ করেন রামগঞ্জ উপজেলার চাষিরা। চলতি বছর ১০ হেক্টর বাড়িয়ে ৫০ হেক্টর জমিতে সয়াবিনের আবাদ করেছেন তারা।
মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা জানান, গত বছর ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে মেঘনার উপকূলীয় এলাকায় বিভিন্ন ক্ষেতে সয়াবিন নষ্ট হয়। তাই চলতি মৌসুমে কিছুসংখ্যক চাষি আবাদ পরিবর্তন করেছেন। এ বছর আবারও ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে কিছুসংখ্যক সয়াবিন ক্ষেত পানিতে নিমজ্জিত হয়। তবে কৃষকরা দ্রুত সয়াবিন কেটে ফেললে উৎপাদনে প্রভাব পড়েনি।
সদরের ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চরউভূতা ও কমলনগর উপজেলাসহ সয়াবিন ক্ষেতে গিয়ে দেখা গেছে, পাকা সয়াবিন মাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত চাষিরা। আবার কিছু অংশে বৃষ্টিতে সয়াবিনের ক্ষেত পানিতে ডুবে আছে। চাষিরা পানি থেকে সয়াবিন গাছ কেটে নিচ্ছেন। কমলনগরের সয়াবিন চাষি নুর হোসেনসহ কয়েকজন চাষি বলেন, গত কয়েক বছর সোহাগ জাতের সয়াবিন চাষ করে আসছি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তবে চলতি বছর কৃষি বিভাগের পরামর্শে উচ্চ ফলনশীল বিইউ ও বিনা জাতের সয়াবিন চাষ করেছি। এবার ফলনও হয়েছে ভালো।
এই দিকে আবাদ পরিবর্তন করা ক্ষতিগ্রস্ত কমলনগর উপজেলার চরজাঙ্গালিয়া গ্রামের সয়াবিন চাষি আবুল খায়ের, রায়পুর উপজেলার হায়দারগঞ্জ এলাকার আবদুল মতিনের অভিযোগ- অধিকাংশ কৃষক ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করেন। কৃষি কর্মকর্তাদের তদারকি অভাবে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক কৃষকদের প্রণোদনার আওতায় আনা হলে সয়াবিন চাষে আগ্রহী হয়ে উঠবেন তারা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ড. জাকির হোসেন বলেন, জলাবদ্ধতা সহ্য করতে না পারায় সয়াবিন গাছ পচে যায়। তাই জলাবদ্ধতাসহিষ্ণু সয়াবিন উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. খালেদ কমলনগর উপজেলায় কিছু নতুন জাতের সয়াবিন ট্রায়াল ফলক বসিয়েছেন। ট্রায়াল ফলকটি পানিসহিষ্ণু সফল হলে জাতটি আবাদে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হবে। তিনি বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সব কৃষককে নিয়ে কাজ করে থাকে। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুর জেলায় সয়াবিন উৎপাদন ভালো হওয়ায় এই জেলার কৃষকদের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ নজর রয়েছে। আমরা সয়াবিন চাষিদের জন্য সবসময় কাজ করে যাচ্ছি।
দেশে মোট উৎপাদিত সয়াবিনের ৮০ শতাংশই হয় লক্ষ্মীপুরে। ১৯৮২ইং সালে জেলার রায়পুর উপজেলার হায়দারগঞ্জে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে সয়াবিনের চাষ করে মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি (এমসিসি) নামে একটি সংস্থা। উৎপাদন উপযোগী উর্বর মাটি ও অনুকূল আবহাওয়ার কারণে প্রথমবারেই উৎপাদনে আসে বড় ধরনের সাফল্য। এরপর জেলার বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে শুরু হয় সয়াবিন। এই অঞ্চলের সয়াবিন চাষের সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে লক্ষ্মীপুরে সয়াবিনভিত্তিক শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।