রাজনীতিতে আগাছা-পরগাছা

আরো পরিবেশ বিশেষ প্রতিবেদন বিশেষ রচনা বলি রাজনীতি শিক্ষা শিক্ষা সাহিত্য সারাদেশ সাহিত্য
শেয়ার করুন...

আবুল কাশেম উজ্জ্বলঃ
শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

ছোটবেলায় দেখেছি গ্রামে বিশেষ কাজে বিশেষ ব্যক্তিকে সবাই ডাকত। বিয়ে বা যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে তাদের বিশেষ কদর থাকত এবং তারাও হাসিমুখে কাজ করতেন। আবার চিঠি বা দরখাস্ত লেখা বা দাপ্তরিক কাজের জন্যও মানুষ কয়েক গ্রাম ঘুরে নির্দিষ্ট মানুষের কাছে যেত। ওই মানুষগুলোর কখনও নিজেকে প্রচার করতে হতো না, বরং মানুষই তাদের গুণ প্রচার করত। সময় বদলেছে, বদলেছে আমাদের রুচি, চিন্তাভাবনা। ইদানীং অনেকেই নিজেকে গুণী ভাবা শুরু করেছেন, এমনকি কেউ স্বীকার না করলে তর্ক-কুতর্ক করে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করা লোকের অভাব নেই।
আমার গ্রামের বাড়ি এমন এক জায়গায়, যেখানে প্রাকৃতিক বনের অভাব ছিল না। ছোটবেলায় দেখতাম রাত হলেই ট্রাক ভরে গাছ পাচার হতো। বনগুলোতে সেগুন-মেহগনিসহ ভালো জাতের গাছের অভাব ছিল না। এখন সেগুলোর অস্তিত্ব প্রায় নেই, মাঝে মাঝে পত্রিকায়ও সংবাদ আসে। যারা অবৈধভাবে ওই কাজ করত, তারাও সরকারদলীয় তকমা লাগিয়ে নিত। তাদেরই একজন একবার মজা করে বলেছিলেন, আমাদেরও সংগঠন আছে, তবে সেটা সবাইকে বলি না, জায়গামতো প্রকাশ করি। যেভাবে ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য দলীয় তকমা কাজে লাগিয়ে কিছু মানুষ জঘন্য কাজ করে যাচ্ছেন তা মোটেও ভালো কিছু নয়। বরং এভাবে চললে একদিন সবকিছুই দলীয় তকমায় চলে যাবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশে মানুষ ডিজিটাল উপায়ে রাতারাতি সব পেতে চায়। ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া তা আরও সহজ করেছে। মাঠের রাজনীতি এখন সেলফি-ফেসবুক আর ড্রয়িংরুম রাজনীতি হয়ে গেছে। কিছু মানুষ তো আরও সরস, যাদের কাজ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্টম্ন ফেরি করে নিজের আখের গোছানো; অনেকটা বিনা পুঁজিতে ব্যবসা করার মতো। তাদেরও কিছু গুরু থাকেন, যাদের আশীর্বাদে তাদের এমন উত্থান হয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলেই এই গুরুরা সুর পাল্টান।
দর্জি মনির, হেলেনারা তো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, অতীতেও এ রকম চরিত্র ছিল। খুব বেশিদিন আগে নয়, যখন আমরা সাহেদ-পাপিয়াদের দাপট ও কুকীর্তি দেখেছি। তাদের সঙ্গে অনেক প্রভাবশালীর সম্পর্ক, যোগাযোগ, ঘনিষ্ঠতা, দহরম-মহরম থাকে। তারা দাবার বোর্ডের একেকটা সৈন্য মাত্র, নেপথ্যের নায়করা নতুন সৈন্য নিয়ে আসবে। কারও সমস্যা হচ্ছে না, হবেও না, কেবল আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কষ্টটা বাড়ে। কারও নামে সংবাদ এলে দল একটাই কাজ করে, দল থেকে বহিস্কার। অথচ যারা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা থাকেন নিরাপদে।

উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী দেশের প্রতি, মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ও ভালোবাসার এক প্রামাণ্য দলিল। ন্যায়ের জন্য স্কুলজীবন থেকেই জেল খাটা শুরু, চলেছে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত। নিজের মেধা, শ্রম, অর্থ ব্যয় করে রাজনীতি করেছেন মানুষের জন্য, রাতারাতি নেতা বা ধনী হওয়ার জন্য নয়। স্বাধীনতার আগেই আওয়ামী লীগ হয়েছিল তৃণমূল মানুষের সংগঠন, রাজধানী থেকে গ্রামবাংলায় ছিল শক্তিশালী চেইন অব কমান্ড। ১৯৮১ সালে সে দলের হাল ধরেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অগণতান্ত্রিক সরকার হটিয়ে আওয়ামী লীগ আজ রাষ্ট্রক্ষমতায়। তবে গত এক দশকে দলটিতে হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা অসংখ্য আগাছা যেন আজ ভর করেছে।
বিশ্বে বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। একই ধারা বজায় রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু তাদের অর্জন ম্লান করে এখন আলোচিত হয় আগাছা-পরগাছা নব্য আওয়ামী লীগারদের লাগামহীন দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়নের জন্য। শেখ হাসিনা সজাগ আছেন বলে দুর্বৃত্তদের লাগাম টানার কাজ চলছে, কিন্তু তাদের পৃষ্ঠপোষকরা থেকে যাচ্ছে নিরাপদে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর যদি সত্য হয়, তাহলে ক্ষমতাবানদের প্রভাবশালীদের সঙ্গে সমালোচিত ও ধৃত ব্যক্তিদের সখ্য অনেক প্রশ্ন তৈরি করে।
অতীত থেকেই ছাত্রনেতারা আন্দোলন-সংগ্রাম করে নিজেদের তৈরি করেছেন, পরে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি অর্জন করেছে। সংগঠনের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা, নিষ্ঠা, আদর্শ, দেশপ্রেমের যোগ্যতাই মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। আর এখন বসন্তের কোকিলের অভাব নেই, দলে এখন কাকের ভিড়। উড়ে এসে জুড়ে বসে কে যে কখন কীভাবে প্রভাবশালী হয়, বোঝা বড় মুশকিল।

সিলেট অঞ্চলে এক ধরনের বড় লেবু হয়, যা বেশ জনপ্রিয়। আমার গ্রামের বাড়িতেও এ রকম কয়েকটি লেবুগাছ আছে। ঈদে বাড়ি গিয়ে দেখলাম লেবুগাছগুলো পরগাছার দাপটে প্রায় অদৃশ্য, মাটিতে শুয়ে আছে। পুরো এক দিন লাগল আগাছা কেটে লেবুগাছ উদ্ধার করতে। লেবুগাছের কয়েকটা ডাল কাটতে হলো, যেগুলোর কারণে পরগাছারা সহজে সুযোগ পায়। হয়তো আবারও পরগাছা আক্রমণ করবে, এভাবে হয়তো এক দিন লেবু গাছের প্রয়াণ হবে, যদি যত্ন করা না হয়।

জমি ঠিকভাবে আবাদ করা না হলে বা চাষ করে ফেলে রাখলে আগাছা-পরগাছা জন্মায়। ভালো ফলনের জন্য সময়মতো সেচ, সার দিতে হয়, আগাছা পরিস্কার করতে হয়। তা না হলে সে জমি উর্বরতার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ক্ষমতাও হারায়। পরগাছারা যেমন যে কোনো গাছেই আশ্রয় নেয়, তেমনি সুযোগসন্ধানীদের কাছে দলীয় আদর্শ নয়, আশ্রয় জরুরি। পরগাছা দূর করতে হলে মাঠিকে ভালোভাবে কর্ষণ করতে হয়, যাতে সমূলে বিনাশ হয়। প্রয়োজনে গাছের ডালও কাটতে হয় যাতে পরগাছা ভর করতে না পারে। আশা করি, প্রধানমন্ত্রী সঠিক সময়ে সঠিক কাজটিই করবেন।

image_pdfimage_print

শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published.