মোঃ আবদুল আউয়াল সরকারঃ
পরিবেশকে পরিষ্কার করতে না পারো তাহলে অন্তত নোংরা করো না। পরিবেশ আমাদের অনেক মূল্যবান কিছু উপহার দিলেও বিনিময়ে আমরা পরিবেশকে উপহার হিসেবে দিচ্ছি বিষাক্ত কালো ধোঁয়া, সিসা, দূষিত নোংরা জল, অপরিশোধিত বর্জ্য৷ পরিবেশ দূষণ ঠিক কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে তা ঘর থেকে বেরোলেই আমরা অনুধাবন করতে পারি৷ পরিবেশ নষ্ট করতে বায়ু দূষণ, পানি দূষণের সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে “প্লাস্টিক দূষণ “। প্লাস্টিক এমন একটি অপচনশীল রাসায়নিক দ্রব্য যার জীবনচক্রের কোন সমাপ্তি নেই বললে চলে। এটি সহজে পরিবেশের সাথে মিশেনা। ধরুন, আপনি প্লাস্টিকের বোতল, প্যাকেট ব্যবহারের পর কোন স্থানে ফেললেন। দেখা যাচ্ছে আপনার ফেলা প্লাস্টিক ৫০ মাইক্রনের কম পুরু, তাহলে আপনার ফেলা প্লাস্টিকগুলো সে স্থানে একই রকম ভাবে থেকে যাবে আর সে মাটিতে কোন গাছ জন্মাতে পারবেনা৷ পরিবেশের উপর প্লাস্টিক দ্রব্যাদির এমন নেতিবাচক প্রভাবকে “প্লাস্টিক দূষণ” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়৷ দৈনন্দিন জীবনে আমাদের ব্যবহৃত সিংহভাগ জিনিসেই প্লাস্টিকের উপস্থিতি বিদ্যমান। দোকান থেকে জিনিস আনার জন্য কেউ এখন আর কাগজের বা কাপড়ের তৈরি ব্যাগ নিয়ে যায় না। টুথব্রাশ, টুথপেষ্ট থেকে শুরু করে মোবাইল, পড়ার টেবিল থেকে শুরু করে জিনিসপত্র রাখার কেস, এমনকি আমাদের লেখার জন্য ব্যবহৃত কলম অবধি প্লাস্টিকের তৈরী। বর্তমানে জীবন রক্ষাকারী ঔষুধ প্লাস্টিকের মোড়কে প্যাকেটজাত করা হয়। এসব কিছুই আমাদের প্লাস্টিকের উপর অতিরিক্ত মাত্রায় নির্ভরশীলতাকে প্রমাণ করে। এত মাত্রায় প্লাস্টিক দ্রব্যাদির উপর নির্ভরশীলতার প্রথম কারণ হচ্ছে এর কম মূল্য ও সহজলভ্যতা৷ প্লাস্টিকের তৈরী জিনিস দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যবহার করা যায়, পরিষ্কার করা বেশ সহজ ও এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতেও খুব একটা ঝামেলা পোহাতে হয়না।প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিল খুব সহজে ঘরের এক কোণায় গুটিয়ে চলে রাখা যায়। এ সকল কারণে বর্তমানে প্লাস্টিক দ্রব্যাদি ব্যবহারের পরিমাণ অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে গেছে।
মূলত, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত ও সহজ করার লক্ষ্যে প্লাস্টিকের আবিষ্কার। প্লাস্টিক আমাদের অনেক কাজ সহজ করে দিয়েছে আবার এটি আর্থিকভাবেও সাশ্রয়ী। কিন্তু প্লাস্টিক দূষণের জন্য বিজ্ঞান দায়ী নাকি আমরা- সে উত্তর আমাদের নিজেরই খুঁজে বের করতে হবে। সাল আবিষ্কারক ধরণ
১৮৫০ আলেকজান্ডার পার্কস প্রাকৃতিক রবার থেকে প্লাস্টিক তৈরী করেন
১৮৬৯ জন ওয়েসলে হায়াত কৃত্রিম পলিমার ও সেলুলয়েড
১৯০৭ লিও বেকেল্যান্ড সম্পূর্ণ কৃত্রিম প্লাস্টিক
প্রাত্যহিক জীবনে প্লাস্টিক দ্রব্যাদি ব্যবহারের পরিমাণ :
বর্তমানে আমরা প্লাস্টিকের উপর কি পরিমাণ নির্ভরশীল সেটি নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। সমস্যা তখন থেকে শুরু হয় যখন আমরা ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ব্যাগ, প্যাকেট, বোতল যেখানে সেখানে ফেলে রাখি। প্রতি মিনিটে তরল পদার্থের সাথে ১০ লক্ষ প্লাস্টিকের বোতল ক্রয় করা হয়।
প্রতিনিয়ত আমরা প্লাস্টিকের দ্রব্য ব্যবহার করলেও দেখা গেছে তার মধ্যে ৫০ শতাংশ একবার ব্যবহারের পরেই আমরা ফেলে দিচ্ছে৷
এক দশকে আমাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিকের পরিমাণ বিগত এক শতাব্দীর ব্যবহৃত প্লাস্টিকের থেকেও বেশি।
প্রতি বছর মোট প্রায় ৫০ হাজার কোটি প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করা হয়।
প্রায় ৮০ লক্ষ টনের মত প্লাস্টিক বর্জ্য আমরা প্রতি বছর নদী-নালাতে ফেলি।
প্লাস্টিকের অপব্যবহারের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের জলজ প্রাণী আজ হুমকির মুখে। কারণ আমরা রাস্তাঘাটে, ড্রেনে যে প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো ফেলি তা বৃষ্টির পানিতে ভেসে নদীপথ হয়ে সোজা সমুদ্রপৃষ্ঠে পতিত হয়। আর এই প্লাস্টিকগুলো সমুদ্র বছরের বছরের বিদ্যমান থাকে৷ এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি মিনিটে সাগরে পতিত হওয়া প্লাস্টিক বোতল ও ব্যাগের সংখ্যা প্রায় ৩৩ হাজার ৮০০টি। প্রতি বছরে যা ১৩ মিলিয়ন টনে গিয়ে দাঁড়ায়৷ এভাবে চলতে থাকলে দেখা যাচ্ছে ২০৫০ সালে মাছের চেয়ে সমুদ্রে প্লাস্টিক বেশি থাকবে৷ প্রতি বছর প্লাস্টিক উৎপাদনে প্রায় ১৭ মিলিয়ন ব্যারেলের মত তেলের দরকার হয়। শুধুমাত্র ১ কেজি প্লাস্টিক উৎপাদনে ২ থেকে ৩ কেজি পরিমাণ বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। এই বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ব্যাপকভাবে দায়ী৷
আমাদের অতিরিক্ত প্লাস্টিক ব্যবহার করা অনেকটা “নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মত”। বাজার থেকে মাছ, মাংস, ডিম কিনে আনার পর প্লাস্টিকের পাত্র ভরে আমরা ফ্রিজে রেখে দেই। কিন্ত, এই পাত্র পোড়ালে তা থেকে নির্গত স্টাইরিন গ্যাস নিঃশ্বাসের মাধ্যমে বা লোমকূপ দিয়ে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে মাথাধরা, ক্লান্তি, দূর্বলতা এমনকি স্নায়ুতন্ত্র বিকল হওয়ার মতো জটিল রোগের সৃষ্টি করে৷ সমুদ্রে জমে থাকা প্লাস্টিকের উপর যখন সূর্যের আলো পড়ে তখন সেটি মাইক্রো প্লাস্টিকে পরিণত হয়। আর এই মাইক্রো প্লাস্টিক মাছের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে।
শুধুমাত্র সমুদ্রে পতিত হওয়া প্লাস্টিকের কারণে প্রায় ৮০০ প্রজাতির সামুদ্রিক জলজ প্রাণী নানা রোগে আক্রান্ত হয়৷ ধারণা করা হচ্ছে, শুধুমাত্র প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে সমুদ্র থেকে কচ্চপ একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। শুধুমাত্র জলজ প্রাণী নয়, প্রায় ১০ লাখের মতো পাখি প্রতিবছর প্লাস্টিক দূষণের শিকার হয়৷ সময় এসেছে প্লাস্টিক দূষণ তীব্রতর রূপ ধারণের আগে এটিকে প্রতিহত করার। প্লাস্টিক দূষণ রোধে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে রিসাইক্লিং। মানে একবার ব্যবহার করা হয়েছে তেমন প্লাস্টিকগুলো ফেলে না দিয়ে আবার ব্যবহার করা। তাছাড়া, ৫০ মাইক্রনের কম পুরু প্লাস্টিকগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা এখন সময়ের দাবী। প্লাস্টিকের ব্যাগের পরিবর্তে কাপড়ের বা পাটের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হতে পারে ভালো একটি সমাধান। পরিবেশকে আমরা যতখানি দেব পরিবেশ ঠিক আমাদের ততখানিই ফেরত দেবে৷ প্লাস্টিক আমাদের জীবনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সেটি অস্বীকারের কোন উপায় নেই৷ কিন্তু, প্লাস্টিক ব্যবহারের পর নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণের দায়িত্ব কিন্তু আমাদের।
লেখকঃ
চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ,শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।