বৃষ্টি বন্ধ হওয়ায় নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। চকরিয়া-পেকুয়ার ১৯ ইউনিয়ন ও রামুসহ অন্য প্লাবিত নিম্নাঞ্চলে পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠছে মহাসড়ক, উপসড়ক, কাঁচা রাস্তা ও বাঁধের ক্ষতচিহ্ন। কালভার্ট ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে অনেক এলাকা। নষ্ট হয়েছে বীজতলা, ফসলের মাঠ, মাছের ঘের ও বেড়িবাঁধ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘর-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ রেললাইন।
চলমান বন্যায় শিশুসহ ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এমনকি বন্যার পরে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ঘরে ফেরা মানুষগুলো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সংকটে পড়েছে। যদিও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ত্রাণ পৌঁছেনি বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা। চারদিন পর কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানচলাচলও স্বাভাবিক হয়েছে।
শুক্রবার (১১ আগস্ট) সকালে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে আসছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ৬০ ইউনিয়নে চার লাখ ৭৯ হাজার ৫০৩ জন বন্যার কবলে পড়েছেন। সে সময় চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় ১৬২টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নেন। এসব মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের পাশাপাশি ৩৭ হাজার ৫০০টি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করা হয়। মজুদ রয়েছে আরও ৫০ হাজার। এ সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৯ কিলোমিটার সড়ক- উপসড়ক। এখনো বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে পেকুয়ার ৬টি এবং চকরিয়ার ১৩টি ইউনিয়ন। প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক কোটি সাড়ে ৪০ লাখ টাকা। পানি কমে গেলে চুড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী মন্জুর আলম বলেন, বন্যার সময় দুর্গতদের মধ্যে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা চ্যালেঞ্জ। আমরা এ পর্যন্ত ৩৭ হাজার ৫০০টি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ২০০টি পানিসহ জেরিকেন এবং ৫০০০ লিটার পানি সরবরাহ করেছি। আরও ৫০ হাজার ট্যাবলেট আমাদের মজুদ রয়েছে। কক্সবাজারের পাশাপাশি বান্দরবানও আমাদের সাপোর্ট দিতে হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) দুপুরে পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে পেকুয়া ও চকরিয়ায় পাঁচ শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে পেকুয়া উপজেলায় তিন ও চকরিয়ার দুই শিশু রয়েছে। এছাড়া বানের পানি নেমে গেলে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়া সেপটিক ট্যাংক, সেটি পরিষ্কার করতে গিয়ে গ্যাসের বিষক্রিয়ায় বাবাসহ দুই ছেলের মৃত্যু হয়েছে। মৃতরা হলেন, চকরিয়ার বিএমচর ইউনিয়নের দক্ষিণ বহদ্দারকাটা বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন (৭০), তার দুই ছেলে শাহাদাত হোসেন( ৪৫) ও শহিদুল ইসলাম (২২)।
নিহত শিশুরা হলো পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নের নরুল আলমের মেয়ে তাহিদা বেগম (১০) ও ছেলে আমির হোছাইন (৭) এবং তাদের আত্মীয় ছাবের আহমদের মেয়ে হুমাইরা বেগম (৮)। চকরিয়ার বদরখালী ইউনিয়নের ভেরুয়াখালীপাড়ার মো. এমরানের ছেলে মো. জিশান (৯), তবে খুটাখালী থেকে উদ্ধার হওয়া শিশুর পরিচয় এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ।
পেকুয়ার ইউএনও পূর্বিতা চাকমা জানান, বুধবার বিকেলে তিন শিশু সাহেবখালী খালের পাশে তাদের ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে যায়। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে নিখোঁজ হওয়ার পর বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে ওই খালে তাদের লাশ ভেসে ওঠে।
চকরিয়া থানার ওসি জাবেদ মাহমুদ জানান, বৃহস্পতিবার সকালে বদরখালীর ভেরুয়াখালীর নতুন বাজারের পাশে মো. জিশানের লাশ এবং দুপুরে চকরিয়ার খুটাখালী ইউনিয়নের মহেশখালী খালে অর্ধগলিত আরও এক লাশ উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।
লক্ষ্যারচরের আব্দুল গফুর জানান, চারদিন পাঁচ ফুট পানিতে বন্দি ছিলাম। আমার চাষের সবকিছু ধ্বংস হয়েছে। যে ক্ষতি হয়েছে তা কীভাবে পুরণ করবো ভাবতেও পারছি না। সরকারি সহযোগিতা ছাড়া চারদিকে সব অন্ধকার দেখছি।
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় চকরিয়া-পেকুয়ায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে দাবি করে স্থানীয় এমপি জাফর আলম বলেন, গেলো ৫০ বছরেও এমন বন্যা দেখেনি। বন্যায় চিংড়ির ঘের, ক্ষেত-খামার, ঘরবাড়ি থেকে শুরু রাস্তাঘাট, সডক-মহাসড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠা কঠিন।
এখনো জমে থাকা পানি নেমে গেলে চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরুপন করা যাবে বলে জানিয়েছেন চকরিয়ার ইউএনও জেপি দেওয়ান।
বন্যায় তিনদিন বন্ধ থাকার পর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাস ও পরিবহন সংগঠন। বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) সকাল থেকে মহাসড়কসহ আঞ্চলিক সড়কগুলোতে যান চলাচল শুরু হয়।
চারদিনের বন্যায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান জানান, চট্টগ্রামের চকরিয়া ও সাতকানিয়া সংলগ্ন এলাকায় রেললাইনটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় চকরিয়া, পেকুয়া, রামু, সাতকানিয়া ও চন্দনাইশের বেশ কিছু এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত হিসাব করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
বন্যায় রেললাইনের পাথর, মাটি ও বাঁধ ভেসে গেছে। কিছু অংশে রেললাইন হেলেও পড়েছে। এ ক্ষতির কারণে প্রকল্প শেষ হতে দেরি হতে পারে আশঙ্কা করছেন তিনি।
কক্সবাজারের এডিসি (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ জানান, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারে ৬০ ইউনিয়নে চার লাখ ৮০ হাজার মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ভূমিধস ও পানিতে ডুবে মারা গেছেন ১৪ জন। বন্যা দুর্গত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের ১৫ লাখ ৭৫ হাজার নগদ টাকা ও ১০৩ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। বন্যায় প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি দুই কোটি টাকা। সূত্রঃ ইত্তেফাক