বাড়ছে ব্যয় চলে না মানুষের জীবন

অর্থনীতি আরো পরিবেশ সারাদেশ
শেয়ার করুন...

ঢাকায় থাকি!

রাজধানীর মগবাজারের মধুবাগ এলাকায় স্বামী ও এক মেয়ে নিয়ে থাকেন গৃহকর্মী সালমা বেগম। মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বাসায় বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করে সোনিয়ার আয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। আর তার স্বামী একটি বেসরকারি কোম্পানিতে গাড়ি চালাতেন। কিন্তু করোনায় চাকরি চলে যায়। এখন রিকশা চালিয়ে মাসে আয় করেন আট হাজার টাকার মতো। সালমা বেগম বলেন, সংসারের ব্যয় কমাতে দুই রুমের একটি ফ্ল্যাটে সাবলেট থাকেন। কিন্তু গত জানুয়ারিতে তার ঘরভাড়া বেড়েছে।

আর নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় খাওয়া-দাওয়ার খরচ দুইজনের আয় দিয়ে কুলানো যায় না।

তিনি আরও বলেন, হঠাৎ করে সব জিনিসেরই দাম বাড়ছে। কিন্তু আয় বাড়েনি। প্রায়ই মানুষজনের কাছ থেকে ধারদেনা করতে হয়। টিসিবি’র পণ্য কিনতে পারলে কিছুটা সাশ্রয় হয়। কিন্তু লম্বা লাইনে দাঁড়াবো নাকি মানুষের বাসায় কাজ করবো? তাই টিসিবি’র লাইনে দাঁড়ানোর সময় হয় না। শুধু সালমা বেগম নয়, তার মতো বহু পরিবার এরকম কষ্ট করে ঢাকায় জীবন-যাপন করছে।

একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেন উত্তর বাড্ডার তারিকুল ইসলাম। আলাপকালে তিনি বলেন, গত জানুয়ারিতে বাসা ভাড়া বাড়িয়েছেন মালিক। করোনার আগে খাওয়া-দাওয়ার পেছনে মাসে যত খরচ ছিল নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন সেই খরচে কুলানো যায় না। তার দাবি, বেতন যতটা বেড়েছে, তার তুলনায় খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। তাই মাসে মাসে যে সঞ্চয় করতেন, সেটি বাদ দিতে হয়েছে।
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে। সবাই জানিয়েছেন, প্রায় প্রতি মাসেই ধার করে সংসার চালাতে হয়। মাসিক সঞ্চয় করার সুযোগ হয় না। যতটুকু সঞ্চয় ছিল তাও ভেঙে সংসার চালাতেই শেষ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে দিশাহারা মানুষ। যানজট, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, গ্যাস সংকট, দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি, নানা ভয়াবহ সংকট নিয়ে চলছে জনজীবন। কঠিন পরিস্থিতিতে তাদের জীবন ওষ্ঠাগত। ফের বাড়ানো হয়েছে এলপিজির দাম। ঘরে কিংবা বাইরে কোথাও নেই স্বস্তি।
সাধারণ মানুষের জীবন ধারণের প্রায় সবগুলো উপকরণের দাম বেড়েছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির চেয়ে গত মাস ফেব্রুয়ারিতে চাল, তেল, ডাল, মুরগি, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম বা এলপি গ্যাসের দাম বেড়েছে ১৮ থেকে ৮২ শতাংশ পর্যন্ত। ডিজেলের দাম বাড়ায় বাস ও লঞ্চ ভাড়া একলাফে বেড়েছে ২৭ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত।
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মানুষের আয় যদি জীবনযাত্রার ব্যয়ের চেয়ে বাড়ে, তাহলে সমস্যা নাই। যদি জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে আয় না বাড়ে, মানুষের কষ্ট হয়। তখন জীবনযাত্রার মানও কমে যায়। যাদের আয় বাড়ছে না, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটা কখনই কাম্য নয়।
একটি হিসাবে দেখা গেছে, একজন শ্রমজীবী একটি পরিবারের জন্য শুধু চাল কিনতেই বছরে খরচ বেড়েছে ৫০০ টাকার মতো। সয়াবিন তেলে আরও বেশি লাগে। চাল, তেলের মতো বাজারে মাছ, মাংস, সবজির দামও বাড়তি। বছরের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ৫০ টাকা বেড়েছে। আর অধিকাংশ সবজি ৫০-৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর মালিবাগে দেখাশোনার কাজ করেন (কেয়ারটেকার) আতিক। সংসারে তিনি একাই উপার্জনক্ষম। বেতন ২০ হাজার টাকা। বাড়ির কেয়ারটেকার হওয়ায় বাসাভাড়া ফ্রি। তবু সংসার চালাতে নাকাল অবস্থা তার। তার হিসাবে মাসে বাজার খরচ, সন্তানের পড়াশোনা, সন্তানদের স্কুলে পাঠানো আর নিজেদের যাতায়াত এবং ওষুধ ও হাতখরচ ধরলে কিছু থাকে না।
সিপিডি বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বর্তমানে ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের শুল্ক-কর সমন্বয় করা প্রয়োজন। আগামী বাজেটে সাধারণ মানুষের জন্য ভর্তুকি ও সামাজিক নিরাপত্তাবলয় বাড়াতে হবে।
এদিকে রমজানে ফলের চাহিদা থাকলেও দামের কারণে ক্রেতার নাভিশ্বাস। পাঁচ টাকা থেকে শুরু করে কেজিতে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে কোনো কোনো ফলের দাম। ফলে বেশি দামের কারণে ফল কেনা থেকে বিরত থাকছেন ক্রেতারা।
সরজমিন রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আপেল, আঙুর, মাল্টা, খেজুর, পেয়ারা, আনারস, তরমুজ, কলা, পেঁপেসহ রোজায় যেসব ফল বেশি বিক্রি হয় তার প্রায় সবগুলোরই দাম বেড়েছে। ফলে আড়তে যে তরমুজ এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়, সেটি কেজি দরে রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায়।
প্রতি কেজি ফুজিয়া আপেলের দাম ১৯০ টাকা, যা কিছুদিন আগেও ছিল ১৬০-১৭০ টাকা। প্রতি কেজি আঙুর বিক্রি হচ্ছে ২০০-২৪০ টাকায়। কমলার দাম যেখানে প্রতি কেজি আগে ছিল ১৭০-১৮০ টাকা, সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২০-২৩০ টাকা। ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের আনার কেজিপ্রতি ১৮০-৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও মানুষের আয়ের তুলনায় নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেড়েছে।
নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সংসদে বিরোধীদলীয় এমপিদের তোপের মুখে পড়েন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। গত মঙ্গলবার সংসদে বাণিজ্য সংগঠন বিল পাস নিয়ে আলোচনাকালে এ ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
সরকারের দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের কারণেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল সকালে রাজধানীর এক প্রতিবাদ সমাবেশে তিনি এ দাবি করেন।
তবে টিসিবির বিক্রয় কার্যক্রম চলমান থাকায় দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারমূল্য উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে সয়াবিনসহ বেশকিছু পণ্যের দাম বাজারে নতুন করে বেড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে গত মাসে কর ছাড় দেয়ার এক মাস না যেতেই খোলা সয়াবিন তেলের প্রতি লিটারে দাম বেড়েছে ৭ টাকা পর্যন্ত। আর খোলা পামঅয়েলের দাম বেড়েছে লিটারে ১২ টাকা পর্যন্ত।
বাজারের তথ্য বলছে, গত সপ্তাহে খোলা সয়াবিনের দাম ছিল প্রতি লিটার ১৪৫ টাকা। গতকাল সেই সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৫২ টাকা লিটার। সরকারের বিপণন সংস্থার তথ্য বলছে, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দাম বেড়েছে প্রায় এক শতাংশের মতো। নতুন করে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম বেড়েছে ৩ টাকা। গত সপ্তাহে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৬৫ টাকায় পাওয়া গেলেও এই সপ্তাহে কিনতে হচ্ছে ১৬৮ টাকা দিয়ে।
এদিকে রাজধানীর বাজারগুলোতে ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকা পিয়াজের দাম গত এক সপ্তাহে আরও কমেছে। খুচরা বাজারে পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকা কেজি দরে। পিয়াজের মতো কমেছে সজনের ডাটা ও সোনালি মুরগির দাম। তবে এখনো চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে বেগুন ও শসা। বেগুনের কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। আর শসার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা। এর সঙ্গে দাম বেড়েছে ইলিশ ও রুই মাছের।
মুরগির বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আগের সপ্তাহের মতো এই সপ্তাহেও ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা। সোনালি মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩১০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ৩১০ থেকে ৩৪০ টাকা।


শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published.