মিন্টু ইসলাম শেরপুর বগুড়া প্রতিনিধি:
বগুড়ার শেরপুরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কেল্লাপোষী মেলা ২৬ মে ২০২৪ রোববার থেকে শুরু হচ্ছে মেলা চলবে ৩ দিন। প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার থেকে শেরপুর উপজেলার অদূরে দু’ কিলোমিটারের বেশি দূরে কেল্লাপোষী নামক স্থানে ৪৬৮ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে এই মেলার আয়োজন করা হয়। স্থানীয়দের ভাষায়, যাকে ‘জামাইবরণ’ মেলাও বলা হয়ে থাকে। কেননা মেলা বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য। এই মেলাকে ঘিরে এবার গ্রামে গ্রামে চলছে রকমারি আয়োজন। আনন্দ উল্লাস আর উৎসবে মেতে ওঠার অপেক্ষায় লাখো মানুষ। তারা প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকেই নানা ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। মেলা উপলক্ষে সবাই নিজ নিজ আত্মীয়স্বজনকে বাড়িতে দাওয়াত দিচ্ছেন। নিমন্ত্রণে নতুন-পুরনো জামাই-বউ রয়েছেন তালিকার শীর্ষে ও বটে। বউকে নিয়ে শ্বশুরালয়ে আসা জামাইরা থাকেন ভিন্ন মৌজে। কারণ মেলা করতে তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় মোটা অঙ্কের সেলামি। সেই সেলামি আর নিজের গচ্ছিত টাকা দিয়ে জামাইবাবুরা মেলা থেকে খাসি কিনে শ্বশুরবাড়িতে আনেন। এমনকি বড় বড় মাটির পাতিল ভর্তি করে মিষ্টান্ন সামগ্রী, সবচেয়ে বড় মাছ, মহিষের মাংস, রকমারি খেলনা কিনে নেন। এছাড়া শ্যালক-শ্যালিকাদের নিয়ে মেলা ঘুরে ঘুরে দেখেন। তাদেরকে সার্কাস, নাগরদোলা, হুন্ডা খেলা, জাদু খেলা, পুতুল নাচ দেখিয়ে দিনব্যাপী আনন্দ শেষে ছাতা, ছোটদের কাঠের ও ঝিনুকের তৈরি খেলনা সামগ্রী নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরেন। আর মেলা থেকে রকমারি মসলা, তুলা, কাঠের সামগ্রী, বড় বড় ঝুড়ি, চুন সারাবছরের জন্য কিনে রাখেন গ্রামের সাধারণ মানুষ।
প্রতিটি মেলার পিছনেই কিছু না কিছু লোকগাথাা থাকে। তাই প্রাচীন এই কেল্লাপোষী মেলা সম্পর্কে তেমনি একটি লোকগাথার কথা জানা যায়। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই মেলা হয়ে আসছে বলে কথিত আছে। এ সম্পর্কে জানা যায়, বৈরাগ নগরের বাদশা সেকেন্দারের একজন ঔরশজাত পুত্র এবং একজন দত্তক পুত্র ছিলেন। ঔরসজাত পুত্রের নাম গাজী মিয়া ও দত্তক পুত্রের নাম কালু মিয়া। গাজী মিয়া দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন। তারা রাজ্যের মায়া ত্যাগ করে ফকির-সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে ঘুরতে ঘুরতে ব্রাহ্মণ নগরে আসেন। সেখানে ব্রাহ্মণ রাজমুকুটের একমাত্র কন্যা চম্পা গাজীকে দেখে মুগ্ধ হন। এক পর্যায়ে তারা দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলেন। পালিত ভাই কালু মিয়া বিষয়টি জানতে পেরে গাজীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মুকুট রাজার নিকট যান। মুকুট রাজা ফকিরবেশী যুবকের এরূপ স্পর্ধা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বন্দি করেন। এতে গাজী মিয়া দারুণ আঘাত পান। তিনি মুকুট রাজার নিকট থেকে ভাই কালু মিয়াকে উদ্ধারের জন্য কেল্লাপোষী নামক স্থানে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। পরে রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করে ভাইকে উদ্ধার এবং তার কন্যাকে বিয়ে করেন। আর ওই দিনটি ছিল জ্যেষ্ঠ মাসের দ্বিতীয় রোববার। ওই সময় গাজীর বিয়ে উপলক্ষে কেল্লাপোষী দুর্গে নিশান উড়িয়ে তিন দিনব্যাপী আনন্দ উৎসব চলে এবং সেখানে মাজার গড়ে তোলা হয়েছে। মেলা চলাকালে সেখানে ভক্তরা আসর বসায়। ওই দিনগুলোকে অম্লান করে রাখতে প্রতি বছর জ্যেষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার থেকে তিন দিনব্যাপী মেলা বসে। আর এই মেলা উপলক্ষে এলাকাবাসী নতুন জামাইকে ঘরে এনে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন। এছাড়া নিকট আত্মীয়স্বজনের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা এলাকা। এছাড়াও মেলা শুরুর প্রায় সপ্তাহখানেক আগ থেকে গ্রামে গ্রামে চলে মাদার বাশ খেলা। একটি বড় বাঁশ লাল কাপড়ে মুড়িয়ে ও নানা রঙে সাজিয়ে এবং সেটির বিভিন্ন স্থানে চুল লাগিয়ে ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল বেরিয়ে পড়ে। ঢাক- ঢোল, গান-বাজনার নানান সরঞ্জামাদি আর লাঠি নিয়ে তারা গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে শহরে খেলা দেখায়। মেলা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত চলে ওই মাদার খেলা। জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার দলটি মেলা এলাকায় অবস্থিত মাজার প্রাঙ্গণে গিয়ে তা শেষ করেন। এ বছরও মেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্নস্থানে মাদার খেলা চলছে। আর ঐতিহ্যবাহী এই মেলাকে সামনে রেখে এলাকায় সাজ সাজ রব বিরাজ করছে ।
শেরপুর উপজেলা থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ৩ দিনব্যাপী এ মেলায় সার্কাস, নাগরদোলা, পুতুল নাচ, বিচিত্রা, হোন্ডাখেলা, কারখেলাসহ নানা অনুষ্ঠান চলে। সেই সঙ্গে জুয়াড়িরা পাল্লা দিয়ে মেলা দেখতে আসা সহজ সরল মানুষকে ঠকিয়ে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। মেলায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কেনাকাটার ধুম। দূরদূরান্ত থেকে আগত বিক্রেতারা এখানে দোকান সাজিয়ে জাঁকিয়ে বসেন বেচাকেনার জন্য। এই মেলার প্রধান আকর্ষণ হলো বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাবপত্র, মিষ্টি-ফলমূল, নানা জাতের বড় বড় মাছ, কুঠির শিল্প সামগ্রী, মহিষ ও খাসির মাংস, রকমারি মসলা। তিন দিন মেলা চলার নিয়ম থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা ছয়-সাত দিনে গড়ায়। এই মেলায় কোটি টাকার দ্রব্যাদি কেনাবেচা হয় কাঠের আসবাবপত্রসহ মেলায়। এবারের মেলার সমস্ত প্রস্তুতি প্রায় শেষের দিকে তাই ২৬ মে রবিবার থেকেই মেলা শুরু হবে। এব্যাপারে বগুড়া শেরপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সজিব শাহরীন (শেরপুর সার্কেল) এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন মেলার নিরাপত্তার জন্য এবং মেলার অশ্লীলতা বন্ধে শেরপুর থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি সবসময় থাকবে।