দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়েস্টার্ন কেপের ছোট্ট এক দ্বীপ রবেন আইল্যান্ড। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লুবার্গ স্ট্যান্ড উপকূল থেকে ৬ দশমিক ৯ কিলোমিটার ও কেপটাউন জাহাজঘাট থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে আটলান্টিকের টেবিল উপসাগরে এ দ্বীপটির অবস্থান। পৃথিবীর দক্ষিণ প্রান্তে আটলান্টিক মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর যেখানে মিলিত হয়েছে, তার ঠিক পশ্চিমে কেপটাউন শহর।
আয়তনে ছোট এবং ডিম্বাকৃতির এ দ্বীপটি লম্বায় সাড়ে তিন কিলোমিটার এবং চওড়ায় দুই কিলোমিটার। প্রাচীনযুগে দ্বীপটি মূলত পর্বতের প্রান্ত হিসেবে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সবশেষ বরফ যুগের প্রায় ১২ হাজার বছর আগে ক্রমবর্ধমান সমুদ্রস্তর উপকূল থেকে এ দ্বীপকে পৃথক করে। ১৫০০ শতকের প্রথমার্ধেও পৃথিবীবাসীর কাছে রবেন দ্বীপ ছিল অজানা। ১৪৮৮ সালে টেবিল উপসাগরে জাহাজ নোঙরের সময় দ্বীপটির অস্তিত্ব খুঁজে পান পর্তুগিজ পর্যটক বাতোলোমিও ডায়াস। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ওলন্দাজরা কেপ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করতে আসে। অল্প সময়ে তারা এ দ্বীপকে কারাগার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে।
প্রথমদিকে কৃষিকাজে ব্যবহূত হলেও পরে দ্বীপটি ক্রীতদাসদের জন্য নির্ধারিত হয়। বিভিন্ন সময়ে রবেন দ্বীপকে নির্বাসনের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। সবসময় অপরাধী নয়, কুষ্ঠরোগীদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্যও ব্যবহূত হতো এ দ্বীপটি। ১৯৬১ সাল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার রাজনৈতিক বন্দি এবং সাজাপ্রাপ্তদের নির্বাসনের জন্য দ্বীপটিকে নির্বাচিত করে। রবেন দ্বীপের প্রথম বন্দি ছিল স্ট্র্যান্ডলপার নেতা অতশুমাতো। ঊনিশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে আফ্রিকান নেতারা এ দ্বীপে নির্বাসিত হন। আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা দীর্ঘ আঠারো বছর (১৯৬৪ থেকে ১৯৮২) এ নির্জন দ্বীপে কারাবন্দি থেকেছেন।
রবেন দ্বীপ নির্জন হলেও প্রাণীশূন্য নয়। মানুষের সংখ্যা তেমন না হলেও এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা বেশ কয়েকটি প্রাচীন কচ্ছপ আর পেঙ্গুইন। প্রচুর সামুদ্রিক প্রাণী সিল পাওয়া যাওয়ায় দৃষ্টিনন্দন দ্বীপটির নাম হয়েছে ‘সিল দ্বীপ’। দ্বীপটির খ্যাতি তার কারাগারের জন্যই। প্রতিদিন পৃথিবীর অসংখ্য পর্যটক নৌযানে করে রবেন দ্বীপে ঘুরতে যান। এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণ হলো নেলসন ম্যান্ডেলার বন্দিশালা।
এ দ্বীপটি রাতে প্রেতভূমির মতো মনে হয়। চারদিক শুনশান নীরবতা। শুধু শোনা যায় সাগরের ঢেউ ছুঁয়ে শনশন বাতাসের শব্দ। অমাবস্যার রাতে দ্বীপটি যেন আঁধারপুরী! কিন্তু জ্যোত্স্না রাতে আটলান্টিকের ঘন নীল পানি মনকে উদাস করে দেয়। ১৯৯৭ সালে রবেন দ্বীপটি একটি জাদুঘরে পরিণত হয়। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার রবেন দ্বীপকে দেশের অন্যতম জাতীয় জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করে। নির্বাসনের জন্য ব্যবহূত দ্বীপটি এখন নিষ্ক্রিয় কারাগার হিসেবেই পরিচিত।
পুরো দ্বীপটি পর্যটকদের বাসে করে ঘুরিয়ে দেখানো হয়। দেখানো হয় কারাগারে থাকা বিভিন্ন বন্দিদের দলিল ও ব্যবহূত জিনিসপত্র এবং ঐতিহাসিক স্থান। দ্বীপটি এখন নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হয়ে উঠেছে। পর্যটকরা সহজেই রবেন দ্বীপ ভ্রমণ করতে পারেন, কারাগারে যেতে পারেন এবং বিভিন্ন অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেন।
সূত্রঃ ইত্তেফাক