তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়) প্রতিনিধি :
ঈদকে সামনে রেখে তেঁতুলিয়ায় ডাহুক নদীতে চলছে নির্বিচারে পাথর উত্তোলন। কিছু অসাধু পাথর খেকোদের নির্যাতনে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে এ নদীটি। নদী হারিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা রূপ। বৈচিত্রের সঙ্গে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। বন্ধ হয়ে গেছে নদীর গতিপথ। নদী সংলগ্ন অনেকের জমি ও বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগও রয়েছে। বর্ষা সময়ে অল্প বৃষ্টিতেই নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে দুই পাড়ের জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে ক্ষতির মুখে পড়ে বিভিন্ন ফসল।
কয়েক বছর আগে, এ ডাহুক নদীর বুক চিরে পাথর তুলতে চালানো হতো অত্যাধুনিক ড্রেজার মেশিন। এসব মেশিনে মাটির ২শ থেকে ২শ ৫০ ফিট গভীর থেকে পাথর উত্তোলনের নদীর বুকে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল বিশাল গর্ত। বুক চিরে ক্ষতবিক্ষত গর্তে নদীটি হারিয়ে ফেলেছে তার রূপ-বৈচিত্র্য। এভাবে পাথর উত্তোলন করলে বড় ধরণের ভূমিকম্পের আশঙ্কার সতর্ক বার্তা দিয়ে আসছেন পরিবেশবিদরা। তবুও থামেনি পাথর উত্তোলন। এখন ড্রেজার মেশিনের পরিবর্তে নদীতে অভিনব পদ্ধতিতে ট্রাক্টর দিয়ে চলছে পাথর উত্তোলন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শালবাহান ইউনিয়নের মাঝিপাড়া, গুচ্ছগ্রাম, লোহাকাচী, বালাবাড়ি, কালিতলাসহ কয়েক কিলোমিটার জুড়ে ও বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের বালাবাড়ি, কাটাপাড়া, সরকারপাড়া ও হারাদিঘী এলাকায় ডাহুক নদীতে চলছে পাওয়ার ট্রাক্টর দিয়ে পাথর উত্তোলন। পাথর খেকোরা পাথর তুলতে বিভিন্নভাবে বিভিন্নজনকে ম্যানেজ করে রাতের আধারে চালিয়ে আসা পাথর উত্তোলনে নদীটি গভীরতা ও গতিপথ হারিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। নাব্যতা হারিয়ে চরম অস্তিত্ব সংকটে ডাহুক নদী ।
সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাক্টর দিয়ে পাথর তুলছেন এক শ্রেণির অসাধু পাথর খেকোরা। তারা ড্রেজার মেশিনের জায়গায় নতুন পদ্ধতি হিসেবে বেছে নিয়েছেন পাওয়ার ট্রাক্টর। স্থানীয়দের সাথে কথা বললে তারা জানান, নদীতে প্রায় ১০০ সাইট রয়েছে। এসব থেকে সাইট থেকে রাতের আধারে উত্তোলন হচ্ছে হাজার হাজার সিএফটি পাথর। ট্রাক্টর দিয়ে পাথর উত্তোলন করার ফলে কর্মহীন হচ্ছে হাজারও মানুষ। একটি ট্রাক্টর কমপক্ষে ২০ জনের কর্মসংস্থানে বেঘাত ঘটায়। পাথর শ্রমিকদের দাবী ট্রাক্টর দিয়ে পাথর উত্তোলন না করা।
কিছু পাথর শ্রমিক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সত্তে¡ জানান, ডাহুক নদীতে পাওয়ার ট্রাক্টর দিয়ে পাথর তোলা হচ্ছে। তবে এ পাথর উত্তোলনের কাজের সাথে জড়িত রয়েছে স্থানীয় স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন ও জনপ্রতিনিধি। তাঁর নেতৃত্বে এসব সাইট পরিচালনা করছেন বিশ থেকে পঁচিশজন যুবক। তারা আমাদের কাছ থেকে ট্রলি প্রতি ৬শ টাকাসহ বিভিন্ন অংকের টাকা তুলে নিচ্ছে। আমরা শুধু দিনশেষে হাজিরা টুকু পাচ্ছি। আমরাও নিরুপায়। তাদের নাম বললে আমাদের আর সাইটে পাথর তুলতে দেয়া হবে না।
রফিকুল ইসলাম, রুহুল আমিনসহ আরও কয়েকজন পাথর শ্রমিক জানান, আমরা ডাহুক নদীতে ডুবে পাথর উত্তোলন করতাম। এতে এক গর্তে কমপক্ষে ত্রিশ-চল্লিশ জনের মানুষের প্রয়োজন হতো। এখন পাওয়ার ট্রাক্টর দিয়ে পাথর উত্তোলন করার কারণে মানুষের প্রয়োজন হয় ৮-১০ জনের। এতে আমরা পাথর শ্রমিক বিপাকে পরেছি। প্রশাসনের কাছে ট্রাক্টর দিয়ে পাথর উত্তোলন বন্ধের দাবি জানান তারা।
আফরোজা বেগম নামের এক নারী অভিযোগ করে সাংবাদিকদের বলেন, বালাবাড়ি-সরকার পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ডাহুক নদীতে ট্রাক্টর দিয়ে পাথর তোলার কারণে নদীর পাড় ভেঙে আমার জমি ও মেহগনি গাছের বাগান দিনদিন বিলীন হওয়ার উপক্রম। শালবাহান ইউনিয়নের বালাবাড়ি মৌজার ১৮১৯ দাগে ৮০ শতক এবং ১৮২০ দাগে ৩৩ শতক জমি রয়েছে। এরই মধ্যে অনেক জমি ডাহুক নদীতে চলে গেছে। একই সঙ্গে মেহগনি গাছের বাগানের একটি অংশ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। নদীর বর্তমান গতিপথ প্রবাহিত হচ্ছে তার জমির উপর দিয়ে। পাথর খেকোরা বর্তমানে নদী থেকে পাথর তুলে নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছেন।
শালবাহান ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম বলেন, মাঝখানে কয়েকদিন ট্রাক্টর দিয়ে পাথর তোলা হয়েছিল। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয়ের নিদের্শনায় তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে কালিতলা ব্রীজ ও ডাহুক ব্রীজের ধারে যেসব ক্ষতি হয়েছে তার কারণে ট্রাক্টর দিয়ে পাথর তোলা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
ডাহুক নদীতে ট্রাক্টর দিয়ে পাথর উত্তোলনে জনপ্রতিনিধি জড়িত রয়েছে কীনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অসম্ভব। এসব করার সময় কই। ইউনিয়নের জনগণের সেবা করতেই সময় পাওয়া যায় না। তবে কিছু প্রতিপক্ষ রয়েছে, তারাই এসব বলে বেড়াচ্ছেন। বরঞ্চ নদীতে ড্রেজার কিংবা ট্রাক্টর দিয়ে পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে প্রশাসনকে সাথে নিয়ে বারবার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
তেঁতুলিয়া মডেল থানার ওসি আবু সাঈদ চৌধুরী জানান, ট্রাক্টর দিয়ে পাথর উত্তোলন কারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা ট্রাক্টর জব্দসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। এখন ট্রাক্টর দিয়ে পাথর তোলা বন্ধ রয়েছে। ট্রাক্টর দিয়ে যাতে পাথর তোলা না হয় সেজন্য পুলিশ সার্বক্ষণিক টহলে রয়েছে।
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, বিষয়টি নিয়ে প্রশাসন তৎপর রয়েছে। যাতে কোনভাবেই কালিতলা থেকে ডাহুক নদী পর্যন্ত এ ধরণের ট্রাক্টর দিয়ে কেউ পাথর তুলতে না পারে সে সেক্ষেত্রে নিয়মিত ভ্রাম্যমান অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ডাহুক নদীতে ভ্রাম্যমান অভিযান পরিচালনা করেছি। এতে আমরা ডাহুক নদীর জাতীয় মহাসড়কের ডাহুক সেতুর নীচ সংলগ্ন স্থানে বালু ও মাটি কেটে পাথর উত্তোলনের অপরাধে তিনজনকে তিনদিনের কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে।
উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী মাহমুদুর রহমান ডাবলু বলেন, ডাহুক নদীতে নতুন পদ্ধতিতে ট্রাক্টর দিয়ে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। যা আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক। আমি এ নিয়ে যারা পাথর তুলেন তাদের সাথে কথা বলেছি। ইউএনও ও থানার অফিসার ইনচার্জ এর সাথেও কথা বলেছি। আসলে কী কারণে ট্রাক্টর দিয়ে পাথর উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না। সেখানকার স্থানীয়রা আমার কাছে অভিযোগ করেছেন যে, এ পাথর উত্তোলনের কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি জড়িত। যখন ড্রেজার মেশিন চলছিল, আন্দোলনের মাধ্যমে তখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এখন নতুন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনে এটি পরিবেশ ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধরণের পাথর উত্তোলন যাতে না হয় সেজন্য কঠোর নজরদারি চলছে এবং এর সাথে যারা জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে।