তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়) সংবাদদাতাঃ
তেঁতুলিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ ইউনিটে চান্স পেয়েও টাকার অভাবে ভর্তি অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়িয়েছে এক দিনমজুরের মেধাবী ছেলের। এ মেধাবী শিক্ষার্থীর নাম মেধাবী শিক্ষার্থী মুক্তারুজ্জামান মুক্তার। সে তেঁতুলিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের গোয়াবাড়ি গ্রামের পাথর শ্রমিক মোশারফ হোসেনের ছেলে। হতদরিদ্র পিতা কিভাবে এ টাকা জোগার করবেন এমন দু:শ্চিন্তায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে ওই মেধাবী শিক্ষার্থী।
মুক্তারুজ্জামানের বাবা মোশারফ হোসেন মহানন্দা নদীতে পাথর তুলে আর মা হনুফা বেগমও পাথর ভাঙ্গা মেশিনে কাজ করেন। এ দিয়েই কোনভাবে চলে তাদের সংসার। তার মধ্যে গত সাত বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে আছে বড় বোন মোকসেদা খাতুন মুক্তি। টাকার অভাবে তারও চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে না। বাড়িতে খেয়ে না খেয়ে, সামান্য টিউশনি করে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি ইউনিটে পরীক্ষায় দিয়ে স্থান অর্জন করতে পারলেও এখন আর্থিকতার কাছে যেন আটকে যাচ্ছে মুক্তারের ভর্তি হওয়ার লড়াই।
রবিবার সকালে মেধাবী মুক্তারুজ্জামানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বাবা মোশারফ হোসেন নদীতে পাথর তুলতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একমাত্র ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় চোখে মুখে হাসি থাকলেও দু:শ্চিন্তায় পড়েছেন ছেলের ভর্তির টাকা নিয়ে।
কিভাবে জোগার করবেন ছেলের ভর্তির টাকা। নিজের ভিটে-বাড়ি ছাড়া জমিজমাও নাই যে বিক্রি করবেন।
বাবা মোশারফ হোসেন জানান, ছেলেটা ছোট থেকেই মেধাবী। যার কারণে ওর লেখাপড়ায় কোন ভাটা পড়–ক তা চাইনি। কষ্ট করেই পড়িয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এখন সে দেশের বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে, কিভাবে যে তার ভর্তি পরীক্ষা জোগার করবো কোন কুল কিনারা পাচ্ছি না। যদি কেউ সহযোগিতায় আসতেন, তাহলে ছেলেটার স্বপ্ন পূরণ হতো।
মেধাবী মুক্তারুজ্জামান জানায়, কঠিন দারিদ্রতার মধ্য দিয়েই আমার বেড়ে উঠা। পঞ্চম শ্রেণি থেকে এসএসসি পর্যন্ত জিপিএ-৫ না পেলেও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ অর্জন করি। এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে ভর্তি হই পঞ্চগড় মকবুলার রহমান সরকারি কলেজে। প্রতিদিন বাড়ি থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে কলেজে যেতে লাগতো বেশ গাড়ি ভাড়া। মেসে থাকার সামর্থ না থাকায় কষ্ট করেই যেতাম কলেজে। ২০২১ সালে এ কলেজ থেকে মানবিক শাখায় পড়ালেখা করে জিপিএ-৫ অর্জন করি। এখান থেকেই স্বপ্ন তৈরি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার। সে স্বপ্নকে জয় করতেই লেখাপড়ায় খুবই মনোযোগী হই।
বিশেষ করে বাবা-মা হতদরিদ্র হওয়ায় চরম হিমশিম খেতে হয়। এ জন্য বাবার সাথেও কাজ করতে হয় আমাকে। লেখাপড়া চালাতে টিউশনি করতে শুরু করি। এখানকার ছেলে-মেয়েদের টিউশনি করিয়ে সে টাকা দিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খ ও ঘ ইউনিটে অংশ নিয়ে খ ইউনিটে ৬৫৪তম ও ঘ ইউনিটে ৬৬৩তম হয়ে মেধা তালিকায় সমাজকল্যাণ ও গবেষণা বিষয়ে স্থান পেয়েছি। এ জন্য আমাকে যারা সহযেগিতা করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমার স্বপ্ন ভবিষ্যতে প্রশাসনের ক্যাডার হয়ে দেশ ও জাতির সেবা করতে চাই। এখন ভর্তির টাকার সংকটে রয়েছে, জানি না টাকা কিভাবে জোগার হবে?
মুক্তারের মা হনুফা বেগম বলেন, ছেলেটাকে তেমন কিছু দিতে পারিনি। আমরা স্বামী-স্ত্রী পাথরে কাজ করছি। এ দিয়ে সংসার চলে না। তাই ছেলেটাকে ভালো কিছু দিতে পারি না। মুক্তার নিজে নিজে প্রাইভেট পড়িয়ে টাকা জোগার করে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। এখন তাকে ভর্তি হতে অনেক টাকা দরকার। কিভাবে টাকা জোগার করবো জানি না। তাই তিনি সমাজের বিত্তবান বা সরকারের কাছে ছেলের সাহায্য-সহযোগিতা কামনা করছেন।
চাচা শরাফত আলী জানান, ছেলেটা এতো মেধাবী যে, বাড়িতে তার লেখাপড়ার মতো পরিবেশ নাই। তারপরেও আমার বাড়িতে এনে দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে। এখন সে দেশের নামকড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে শুনে গর্বে বুক ভরে গেছে। ছেলেটিকে সহযোগিতা করতে পারলে সে অনেক ভালো করবে।
রনচন্ডী দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক ইদ্রিস আলী জানান, মুক্তার খুব মেধাবী ছেলে। আমাদের বিদ্যালয়ে ছাত্র ছিল। ও যখন এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এ জন্য আমরা ৭/৮ হাজার টাকা সহযোগিতা করতে পেরেছিলাম। সে খুব অসহায় পরিবারের ছেলে। এখন তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসহ লেখাপড়া চালিয়ে যেতে অর্থের প্রয়োজন। সমাজের বিত্তশালীদের তার পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেন তিনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, আমি শুনেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তীর্ণ হওয়া মুক্তারুজ্জামান মুক্তার একজন হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে। এরকম প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দরিদ্র পরিবার থেকে দেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হওয়া গর্বের বিষয়। আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মেধাবী মুক্তারের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিসহ লেখাপড়া চালাতে কিছু টাকার ব্যবস্থা করেছি। পাশাপাশি তার বড় বোন যেহেতু মানসিক প্রতিবন্ধী , সে যেন ভাতা পায় তার ব্যবস্থাও করা হবে।