পুলিশকে রাজনীতিমুক্ত রেখে নাগরিক সেবা প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পুলিশ হবে এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা সামগ্রিকভাবে নাগরিকদের নাগরিক সেবা নিশ্চিত করবে। পুলিশ সংস্কারের মাধ্যমে পুলিশ যে জনগণের বন্ধু তার বাস্তব প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশে নিয়োগ বানিজ্য, বদলি বানিজ্য এবং মামলা বাণিজ্য বন্ধ করে শতভাগ দুর্নীতিমূক্ত পুলিশ বাহিনী গঠন করতে হবে। থানাগুলোকে সংস্কার করে জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পুলিশের বেতন কাঠামো সংস্কার করে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
আজ বুধবার (১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪) চট্টগ্রামের একটি হোটেলে এক বিশেষ সংলাপের মাধ্যমে পুলিশ সংস্কারের পথে এসব পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বাস জানানো হয়। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষের অধিকার এই মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ‘পুলিশ সংস্কার বিষয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশ্যা ও করণীয় শীর্ষক’ সংলাপটি আয়োজন করে স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের জন্য সংগঠন ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল এ্যাকশান (ইপসা)। এতে কারিগরী সহায়তা প্রদান করে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ও জেলা পুলিশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আলোচনায় অংশ নেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, স্থানীয় সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী প্রমুখ। একটি আধুনিক, জনমুখী এবং মানবাধিকার-সংবেদনশীল পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয় সংলাপ অনুষ্ঠানে। বক্তারা পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কারকে একটি সম্মিলিত প্রয়াস হিসেবে উল্লেখ করেন, যেখানে সাধারণ মানুষের মতামত ও অংশগ্রহণের গুরুত্ব অপরিসীম। এই সংলাপ যেন সেই জনমতেরই প্রতিচ্ছবি—এমনটাই আশা প্রকাশ করেন বক্তারা।
তিনটি প্রধান বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় সংলাপ অনুষ্ঠান। কিভাবে জনগণের জন্য নিরাপত্তা পরিষেবার মান আরও উন্নত করা যায় এবং পুলিশের সাথে তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ আরও সহজ ও বন্ধুত্বপূর্ণ করা যায়, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। অংশগ্রহণকারীরা তাদের নিজ নিজ অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন। পুলিশের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। এ জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো নিয়েও বিশদ আলোচনা হয়, যেখানে বিভিন্ন প্রকার আইনি এবং পদ্ধতিগত পরিবর্তনের প্রস্তাব আসে। এছাড়া কিভাবে নারী, পুরুষ, শিশু এবং সমাজের প্রান্তিক মানুষের জন্য পুলিশের সেবা আরও সহজলভ্য এবং সমতাপূর্ণ করা যায়, সেই বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়। সমাজের সকল স্তরের মানুষের প্রয়োজন ও অনুভূতির প্রতি সংবেদনশীল একটি পুলিশি ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উঠে আসে।
সংলাপে উপস্থিত সকলে পুলিশ বাহিনীর সামনে থাকা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করেন এবং একটি আধুনিক ও জনমুখী পুলিশি কাঠামো তৈরীর জন্য তাদের মূল্যবান সুপারিশ পেশ করেন। বিশেষ করে, সাধারণ মানুষের সাথে পুলিশের সুসম্পর্ক স্থাপন, মানবাধিকার রক্ষা, এবং পুলিশ বাহিনীতে নারীদের আরও বেশি অংশগ্রহণের বিষয়গুলো আলোচনায় প্রাধান্য পায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক আমীর মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ’র পরিচালনায় সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন ইপসার পরিচালক (অর্থ) পলাশ চৌধুরী। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি নেসার উদ্দিন আহমেদ এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) শাকিলা সোলতানা। সভায় বক্তব্য প্রদান করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর এ. বি. এম. আবু নোমান, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো: শাহ জালাল মিশুক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, চট্টগ্রামের উপ- সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শ্রমিক নেতা তপন দত্ত, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. সাদিকা সুলতানা চৌধুরী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক রিদুয়ান সিদ্দিকী, নীলা আফরোজ, আরিফ মঈনুদ্দীন, তাওহীদ আলিফ, সিটিজেন ফোরামের সহ-সভাপতি মো. আবু সাঈদ সেলিম, ইলমার প্রধান নির্বাহী জেসমিন সুলতানা পারু, এডভোকেট মিলি চৌধুরী, চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের ভিক্ষু ড. সুমন প্রিয়, রাষ্ট্রচিন্তা’র প্রতিনিধি সিয়াম আল জাকি, স্বপ্নীল ব্রাইট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আলী শিকদার, ব্র্যাকের বিভাগীয় ম্যানেজার নজরুল ইসলাম, ব্রাইট বাংলাদেশ ফোরামের প্রধান নির্বাহী উৎপল বড়ুয়া প্রমুখ। এছাড়া সভায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেনীপেশার মানুষ, প্রতিবন্ধী প্রতিনিধি, সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি, ধর্মীয় প্রতিনিধি, কমিউনিটি প্রতিনিধি, যুব সংগঠনের প্রতিনিধিরা বক্তব্য প্রদান করেন।
সংলাপের শেষ পর্যায়ে বক্তারা জানান যে এই আলোচনার মাধ্যমে উঠে আসা সকল মতামত ও সুপারিশ একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন আকারে পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাছে জমা দেওয়া হবে। এই সংলাপ শুধু একটি আলোচনাই নয়, বরং একটি উন্নত ও জনবান্ধব পুলিশি ব্যবস্থার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ—এমনটাই মনে করেন সকলে।