কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা প্রতিনিধঃ
এক সময়কার গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য হোগলা শিল্প এখন কুমিল্লা দক্ষিনাঞ্চলে প্রায় বিলুপ্তির পথে। গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য গরীবের শীতলপাটি হিসাবে খ্যাত হোগলা পাতার চাটাই (বিছানা) প্রতি ঘরে ঘরে ব্যবহৃত হতো। নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ছিল শীতল পার্টি, হোগলা চাটাই ব্যবহৃত হতো মক্তব, মসজিদ, মিলাদ-মাহফিল, পূজা-পার্বন অনুষ্ঠানে বসার জন্য। এছাড়াও ঘুমানোর বিছানা, ঘরের ছাউনী, বেড়া, ফসল রাখার টুকরী, রশি তৈরীতে ব্যবহার হতো। বিত্তবানরাও ব্যবহার করতো গ্রামীণ ঐহিত্য হিসাবে। এটির দাম অপেক্ষাকৃত কম এবং শতভাগ পরিবেশ বান্ধব।
জানা যায়, কুমিল্লা দক্ষিনাঞ্চলে এ চাটাই আসতো নোয়াখালী উপকুলীয় অঞ্চল থেকে। হোগলা গাছ অন্যান্য ঘাষের মতো উদ্ভিদ। উপকূলীয় অঞ্চলে স্যাঁত স্যাতে এটেল মাটিতে প্রকৃতিক ভাবেই জন্মায় হোগলা। তবে বিলুপ্তির পথে হোগলাকে বাঁচাতে বর্তমানে কিছু কিছু অঞ্চলে হোগলা চাষ হয়ে থাকে। এ হোগলা গাছ ৫ থেকে ১২ ফুট লম্বা, ১ থেকে দেড় ইঞ্চি ব্যাসের পাতা জাতীয় গাছ। কাঁচা অবস্থায় গাড়ো সবুজ ও শুকানোর পর কাঠ সোনালী রং ধারন করে। হোগলা শিল্পের কারিগরি মূলত গ্রাম্য নারীরা। বর্তমানে পরিশ্রম অনুযায়ী পারিশ্রমিক না পাওয়ায় এ শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অনেক নারী। পরিবারের পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও বাড়তি উপার্জনে এ শিল্পে শ্রম দিলেও বর্তমানে সে আগ্রহ অনেক কমে গেছে।
এক সময় গ্রামের পর গ্রাম হোগলার বন ছিলো। সেখান থেকে হোগলা কেটে পাটের মত পানিতে জাঁক দিয়ে পানি থেকে তুলে শুকানো হতো। তারপর হাটে-বাজারে বিক্রিসহ নিজেরাই চাটাইসহ অন্যান্য হস্তশিল্প তৈরী করে বাজারজাত করতো। আর যাদের হোগলা ছিল না তারা হাট থেকে শুকনো হোগলা কিনে এনে চাটাইসহ অন্যান্য জিনিষপত্র তৈরী করে বাজারজাত করতো। কিন্তু বর্তমান আধুনিকতার যুগে এ শিল্পের চাহিদা অনেক কমে যাওয়ায় অস্তিত্ব হারাতে বসেছে হোগলা শিল্প। চাহিদা কমার পাশাপাশি মধ্যসত্ত¡ ভোগী দালালদের কারনেও এ শিল্পে ধ্বস নেমেছে।
প্রাচীন ঐতিয্যের হোগলা পাতার এ শিল্পটির রয়েছে এক উজ্বল সম্ভাবনা। এ থেকে পরিবেশ সম্মত পন্য উৎপাদন হয় বিধায় এর ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে। তবে প্রচারের অভাবে এটি তেমন বিকাশ লাভ করেনি। ছোট বিছানা, নামাজের মাদুর, কুশন, ঝুড়ি, টুপি, ছোট ব্যাগ, টুকরী, ঘরের নানান ধরনের ওয়াল্টমেট, হাতপাখা ইত্যাদি নানান পন্যে এ থেকে উৎপাদিত হতে পারে। বিদেশেও এর ব্যাপক চাহিদা থাকায় হোগলা পাতা দিয়ে তৈরী উন্নতমানের হস্তশিল্প তৈরী করে ২/৩টি প্রতিষ্ঠান রপ্তানি করে আসছে। বিদেশে ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এর প্রসার এখনো তেমন ঘটেনি। স্থানীয় ভাবে ফড়িয়া (দালাল) হোগলা পাতার বাজার নিয়ন্ত্রন করে থাকে। গ্রামীণ নারীদের কাছ থেকে খুব অল্পদামে কিনে এরা অধিক মুনাফায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে। চাটাই শিল্পের নারীদের অসহায়ত্বকে পূঁজি করে মুনাফা লুটে নিচ্ছে ঐ চক্রটি।
সরকারী ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা ও ঋণ ব্যবস্থা চালু করে এবং মধ্যভোগী দালালদের দৌরাত্ব কমাতে পারলে এ শিল্পের ভবিষ্যত অনেক উজ্বল হয়ে দাড়াবে বলে সংশ্লিষ্ট অনেকে মত প্রকাশ করেন।
লাকসাম বাজারের হোগলা চাটাই ব্যবসায়ী বরুড়া উপজেলার ফজলু (৪৫) জানান, গত ৩৫ বছর থেকে এ ব্যবসায় জড়িত রয়েছি। এক সময় এ চাটাই চাহিদা ছিলো প্রচুর। দামও ছিলো কম কিন্তু বর্তমানে এ চাহিদা ও সরবরাহ কয়েকগুন কমে গেছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এখন হোগলা চাটাই কেহ কিনতে আসে না। আজ থেকে ২৫ বছর আগে এ বাজারে হোগলা ব্যবসায়ী ছিলো ১০-১৫ জন। কিন্তু বর্তমানে আছে মাত্র দু’জন। ২৫ বছর আগে ১০-১৫ জন ব্যবসায়ী থাকলেও প্রতিদিন আমার বিক্রি ছিলো ১’শ চাটাইয়ের উপর। যার দাম ছিলো প্রতিটি ১৫ থেকে ২০ টাকা। এখন দু’জন ব্যবসায়ী থাকলেও প্রতিদিন বিক্রি করছি ৫ থেকে ৭টি চাটাই দামও চড়া। প্রতিটি চাটাই ৮০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। তিনি বলেন সরকারী ভাবে উদ্যোগ নিলে এ শিল্পের উজ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।