মাওঃ আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়াঃ
সম্মানিত মাসসমূহের মধ্যে প্রথম মাস মুহাররম, যাকে আরবের অন্ধকার যুগেও বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার চোঁখে দেখা হতো। আবার হিজরি সনের প্রথম মাসও মহররম। শরিয়তের দৃষ্টিতে যেমন এ মাসটি অনেক তাৎপর্য ও গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এই মাসে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণও অনেক দীর্ঘ এবং শিক্ষনীয়।
আমরা দেখতে পাই, ইতিহাসের এক জ্বলন্ত সাক্ষী এই মুহাররম মাস। ইসলামের বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে এ মাসেই। শুধু উম্মতে মুহাম্মদীই নয়, বরং পূর্ববর্তী অনেক উম্মত ও নবীদের অবিস্মরণীয় ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল এই মাসে। আশুরা কি এবং কেন? পবিত্র কোরআন-হাদিস এ বিষয়ে কি বলছে? আসুন জেনে নেই এ বিষয়ে।
মুহাররমের ফজিলত :
নামকরণ থেকেই প্রতীয়মান হয় এ মাসের ফজিলত। মুহাররম অর্থ মর্যাদাপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ। যেহেতু অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য ও রহস্যময় তাৎপর্য নিহিত রয়েছে এ মাসকে ঘিরে, আবার এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল, এসব মিলিয়ে এ মাসটি মর্যাদাপূর্ণ। তাই এ মাসের নামকরণ করা হয়েছে মুহাররম বা মর্যাদাপূর্ণ মাস। মুহাররম সম্পর্কে (যা আশহুরে হুরুমের অন্তর্ভুক্ত তথা নিষিদ্ধ মাস) পবিত্র কোরআনে হাকিমে বর্ণিত হয়েছে- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২। যেদিন থেকে তিনি সব আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তন্মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোর সম্মান বিনষ্ট করে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।’ (সুরা তাওবা : ৩৬)
অর্থাৎ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে আল্লাহ তায়ালা ১২টি মাস নির্ধারণ করে দেন। তন্মধ্যে চারটি মাস বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে। ওই চারটি মাস কী কী? এর বিস্তারিত বর্ণনা হযরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, হাদিসে উল্লিখিত হয়েছে, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, এক বছরে ১২ মাস। এর মধ্যে চার মাস বিশেষ তাৎপর্য ও মর্যাদাপূর্ণ । এর মধ্যে তিন মাস ধারাবাহিকভাবে (অর্থাৎ জিলক্বাদ, জিলহজ ও মুহাররম) এবং চতুর্থ মাস মুজর গোত্রের রজব মাস। (বুখারি-৪৬৬২, মুসলিম-১৬৭৯)।
আশুরা : মুহাররম মাস সম্মানিত হওয়ার মধ্যে বিশেষ একটি কারণ হচ্ছে- আশুরা (মহররমের ১০ তারিখ)। এ পৃথিবীর ঊষালগ্ন থেকে আশুরার দিনে সংঘটিত হয়েছে অনেক ঐতিহাসিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। এখানে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হচ্ছে। আশুরার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে- হযরত মুসা (আ.)- ফিরআউনের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি লাভ। এই দিনে মহান আল্লাহ তায়ালা চিরকালের জন্য লোহিত সাগরে ডুবিয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন ভ্রান্ত খোদার দাবিদার ফিরআউন ও তার অনুসারীদের ।
অনেকে মনে করেন, ফিরআউন নীলনদে ডুবেছিল। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুযায়ী এই ধারণা ভুল। বরং তাকে লোহিত সাগরে ডুবিয়ে বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দেওয়া হয়। এ ঘটনা ইমাম বুখারি তাঁর কিতাবে এভাবে বর্ণনা করেন- ‘হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সা.) যখন হিজরত করে মদিনা পৌঁছেন, তখন তিনি দেখলেন যে মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিনে রোজা পালন করছে।
তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, আশুরার দিনে তোমরা রোজা রাখছ কেন? তারা উত্তর দিল, এই দিনটি অনেক বড়। এই পবিত্র দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফিরআউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন আর ফিরআউন ও তার বাহিনী কিবতি সম্প্রদায়কে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হযরত মুসা (আ.) রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি। তাদের উত্তর শুনে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, হযরত মুসা (আ.)-এর কৃতজ্ঞতার অনুস্বরণে আমরা তাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতঃপর তিনি নিজে আশুরার রোজা রাখলেন এবং উম্মতকে তা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করলেন। (বুখারি-৩৩৯৭, মুসলিম-১১৩৯)
আশুরার রোজার গুরুত্ব সম্পর্কে অন্য এক হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী, আল্লাহ তাআলা এর অসিলায় অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন।’ (তিরমিজি শরিফ)
তবে মহানবী (সা.) ১০ মুহাররমের সঙ্গে ৯ বা ১১ মুহাররম মিলিয়ে দুটি রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিস শরিফে এসেছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘আশুরার রোজা রাখতে হলে, তার আগে বা পরেও একটি রোজা রাখবে। কারণ এটি যেন ইহুদিদের অনুকরণে না হয়।’ (মুসলিম শরিফ)
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
আশুরাকে কেন্দ্র করে শিয়া সম্প্রদায় তাজিয়া মিছিল হায় হোসেন ইত্যাদি বলে যে মিছিল ও মাতম করে তা ইসলামী শরীয়ার দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম।
অতএব ,সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা চাই।
যে সকল ভাইয়েরা না বুঝে এই জাতীয় বেদআতী কাজে অংশগ্রহণ করে গুনাহের পাল্লা ভারী করছেন তাদেরকে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে বুঝিয়ে সিরাতে মুস্তাকীম অর্থাৎ সঠিক পথ দেখাবার জন্য বেশি বেশি দাওয়াতী মেহনত করা চাই।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সহীহ ভাবে আমল করার তাওফীক দান করুন! আমীন।
লেখক:
মাওঃ আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া, তরুণ আলেমেদ্বীন বরুড়া, কুমিল্লা।