মোঃ আবদুল আউয়াল সরকার, কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধিঃ বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিল অর্ডিনেন্স অনুযায়ী নার্সিং শিক্ষায় ন্যূনতম ডিপ্লোমা ডিগ্রি না থাকলে কাউকে হাসপাতাল-ক্লিনিকে নার্স হিসেবে নিয়োগ দেয়া যায় না। কিন্তু কুমিল্লার বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো যেন এ আইনের বাইরে। সনদবিহীন বা ভুয়া নার্সে চলছে প্রায় সব বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। কয়েকটি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে দু-একজন সনদধারী, প্রশিক্ষিত বা অভিজ্ঞ নার্স থাকলেও বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর একটিতেও সনদধারী, প্রশিক্ষিত বা অভিজ্ঞ নার্স নেই। এর খেসারত দিতে হচ্ছে রোগী ও স্বজনদের। যথাযথ সেবা থেকে তো বঞ্চিত হচ্ছেনই, কখনও কখনও রোগীকে পড়তে হচ্ছে জটিল পরিস্থিতিতে। এমনকি এর ফলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটছে। যন্ত্রণা, দুর্ভোগ ও ব্যয় বাড়ছে রোগী এবং স্বজনদের।
কুমিল্লা নগরী ও উপজেলা পর্যায়ের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে খোঁজখবর নিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে অভিযোগ মিলেছে, অধিকাংশ হাসপাতালেই কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলছে না, এটি রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা।
প্রায় একমাস আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে কুমিল্লার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন মোঃ শফিকুল মোর্শেদ। তাকে সার্বক্ষণিক দেখভালের জন্য নিযুক্ত করা হয় কয়েকজন নার্স। নার্সদের কর্মদক্ষতা দেখে সন্দেহ হয়। পরবর্তীকালে খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, নার্সিং বিষয়ে তাদের কোনো ডিপ্লোমা বা বিএসসি ডিগ্রি নেই। শিক্ষাগত যোগ্যতা কারও মাধ্যমিক অথবা উচ্চমাধ্যমিক। ওই হাসপাতালে নিয়োগের পর তাদের সবাইকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এরপর থেকেই তারা নার্স হিসেবে রোগীদের সেবায় নিয়োজিত আছেন।
এ চিত্র কুমিল্লার একটি বা দুটি হাসপাতালের নয়, প্রায় সব বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকেরই একই অবস্থা। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণবিহীন নার্স দিয়ে চলছে হাসপাতালগুলো। তাদের নেই নার্সিং কাউন্সিলের নিবন্ধন। ডিপ্লোমা ও বিএসসি নিবন্ধিত নার্সরা তাদের নাম দিয়েছেন ‘ভুয়া নার্স’।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এসব প্রশিক্ষণ ও নিবন্ধনবিহীন অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তি নার্স হিসেবে নিয়োগের ফলে প্রকৃত নিবন্ধিত ও প্রশিক্ষিত নার্সরা চাকরি পাচ্ছেন না। পাশাপাশি হাসপাতালের রোগীরাও তাদের কাছ থেকেও কাক্সিক্ষত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমন কি ডাক্তারদের বিভিন্ন নির্দেশনাও তার সহজেই বুঝতে পারেন না। ফলে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী রোগীকে ওষুধ দেয়াসহ অন্যান্য বিষয়ে মারাত্মক ভুল হওয়ার আশংকা থাকছেই। এরপরও বেসরকারি হাসপাতালের মালিকরা নার্সিং কাউন্সিলের আইন অমান্য করে কয়েকদিনের নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়েই তথাকথিত নার্সদের নিয়োগ দিচ্ছেন। মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে হাসপাতালে ভর্তি হলেও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকছেন রোগীরা। নিবন্ধিত নার্সদের নিয়োগ দেয়া হলে তাদের নির্ধারিত স্কেলে বেতনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয়া বাঞ্ছনীয়। অন্যদিকে তথাকথিত নার্সদের নামমাত্র বেতন দিলেই চলে। শুধু আর্থিক দিক বিবেচনা করেই ক্লিনিক মালিকরা তাদের নিয়োগ দেন বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লা জেলা উপজেলায় ভুয়া নার্স বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে কর্মরত আছেন। কুমিল্লার বেশকিছু নামিদামি হাসপাতালেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ‘ভুয়া নার্স’ কাজ করছেন। বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিলের পক্ষ থেকে হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহে অনিবন্ধিত নার্স নিয়োগ না করতে একাধিকবার সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রদান করা হয়। কিন্তু সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই বেসরকারি হাসপাতালগুলোর কর্তৃপক্ষের।
হসপিটালে ভর্তি থাকা একজন রোগীর অভিভাবক জানান, কিছু আসাধু স্বাস্থ্য ব্যবসায়ী লোকদের রাস্তা থেকে ধরে এনে সাদা এপ্রোন পরিয়ে নার্স বানিয়ে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছে। জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
কুমিল্লার কয়েকটি হাসপাতলের অনুসন্ধানে জানা গেছে, তারা নার্স হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিল কর্তৃক প্র্যাকটিস লাইসেন্স এবং এ বিষয়ে কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই তাদের। পরিচয় জানতে চাইলে এসব ভুয়া নার্স নিজেদের মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন।
এ ব্যাপারে কুমিল্লার কয়েকটি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলে তারা জানায়, যাদের নার্সিং কাউন্সিলের রেজিষ্ট্রেশন নাই তাদেরকে এইড নার্স বা সেবিকা সহযোগী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়।
কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডাঃ মীর মোবারক হোসাইন বলেন, বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিল অর্ডিনেন্স ১৯৮৩ অনুযায়ী বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিলের রেজিষ্ট্রেশন/ লাইসেন্স (পেশাগত সনদ) ব্যতিত কোন নার্সকে কোন হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রদান সম্পূর্ণ অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সুনির্দ্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।