“আমার একটা মেয়ে চলে গেছে, কিন্তু এখন তো কোটি কোটি ছেলে মেয়ে আমার। এই এই কোটি কোটি ছেলে মেয়েরাই তো আমার যে মেয়ে চলে গেছে, তার জন্য লড়াই করছে, তার হয়ে বিচার চাইছে।” কথাগুলো বিবিসি বাংলাকে বলেছেন কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ধর্ষণের শিকার ও খুন হওয়া তরুণী চিকিৎসকের বাবা।
১০ দিন আগে ওই তরুণী চিকিৎসক ধর্ষণ এবং হত্যার শিকার হন। এর প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতজুড়ে বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভ দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে।
বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা যখন নিহত তরুণীর পরিবারের সাথে কথা বলতে যান, কলকাতার উত্তর-শহরতলিতে একটা সরু গলিতে তিনতলা বাড়ির দরজার পাশে দেওয়ালে লাগানো সোনালী রঙের নাম-ফলকটা জ্বলজ্বল করছে। ইংরেজিতে ডাক্তারের নাম লেখা রয়েছে সেখানে।
তার হাতে লেখা একটা প্রেসক্রিপশন ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সাধারণত ডাক্তারদের হাতে লেখা প্রেসক্রিপশন বোঝা দায়, তবে ওই প্রেসক্রিপশনটি গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, আবার বাংলায় লিখে বুঝিয়ে দেওয়া যে কোন ওষুধ কখন খেতে হবে।
“আমার বোনের জামাই ডাক্তার, কিন্তু দরকারে ওর সঙ্গেই কথা বলতাম,” জানাচ্ছিলেন ওই গলির উল্টোদিকের এক দোকানদার। পাড়ার একজন নারী বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “খুব ভাল ডায়াগনোসিস করত ও।”
আর ওর বাবা বলছিলেন, “কেমন ডাক্তার ছিল, সেটা তো ওর রোগীরা ভাল বলতে পারবে!”
গলির মুখে, গলির উল্টোদিকে, বাতি-স্তম্ভে কোথাও তার মুখঢাকা ছবির সামনে কিছু ফুল আর মোমবাতি, কোথাও টাঙ্গানো ব্যানার। সেখানে লেখা “আমরা আমাদের পাড়ার মেয়ের বিচার চাই।”
ওই গলি দিয়েই ৮ অগাস্ট সকাল আটটা ১০ মিনিটে হাসপাতালের ডিউটিতে বেরিয়েছিলেন ওই চিকিৎসক, শেষ বারের মতো। একটানা ৩৬ ঘণ্টা ডিউটিতে থাকার কথা ছিল। তার মধ্যেই তাকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয় হাসপাতালেই।
“বিকেলে একবার ওর মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল, রাত সওয়া ১১টা নাগাদ আরেকবার। সেটাই ওর সঙ্গে আমাদের শেষ কথা,” বলছিলেন ওই চিকিৎসকের বাবা।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বক্ষ-রোগ বিভাগ বা চেস্ট মেডিসিনে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি ছিলেন ওই চিকিৎসক। চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করছিলেন তিনি।
ওই চিকিৎসকের বাবার কথায়, “আগে ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা ছিল না মেয়ের। ও চেয়েছিল ফিজিক্স নিয়ে পড়তে। তবে একটা সময়ে বলে যে ফিজিক্স নিয়ে পড়ার থেকে ডাক্তারিতে চান্স পাওয়া অনেক সোজা। আমরা বলেছিলাম তুই যেমন ভাল বুঝিস, সেটাই কর।”
উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরে ডাক্তারি-র প্রবেশিকা জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়েছিলেন ওই চিকিৎসক। “মেডিক্যাল এন্ট্রান্স দিয়ে প্রথমবারে ও ডেন্টালে চান্স পেয়েছিল। পরের বার আবারও জয়েন্ট দিয়ে এমবিবিএস পড়ার সুযোগ পায় কল্যাণীতে,” জানাচ্ছিলেন ওই চিকিৎসকের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী।
এমবিবিএস পাশ করার পরে বেশ কয়েকটি হাসপাতালে কাজ করেন তিনি। “করোনার সময়ে ও (নিহত তরুণী) মধ্যমগ্রামের একটা হাসপাতালে কাজ করত। পুরো সময়টায় ও একদিনও ছুটি নেয়নি। ওখানকার ডাক্তারবাবুরা বলছিলেন সেই সময়ে ওর কাজের কথা মনে করে,” জানালেন ওই প্রতিবেশী।
তিনিই বলছিলেন, “করোনার সময়ে ও ওর মাকে বলেছিল আমার কাছে লাখ খানেক টাকা জমেছে। তোমাদের যদি কাউকে আর্থিক সাহায্য করার কথা মনে হয়, এটা দিয়ে দিও। ওর বাবার তো স্কুল-ড্রেস তৈরির ব্যবসা। সেখানকার কর্মীদের ওই অর্থ দিয়েছিল ওর মা।”
তারপর তিনি আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন স্নাতকোত্তর পড়তে।
ধর্ষণের শিকার ও খুন হওয়া ওই চিকিৎসকের প্রতিবেশী বলছিলেন, “জানেন ওদের পুরো পরিবারটাই পড়াশোনা নিয়ে থাকতে ভালবাসে। ওর পড়ার ঘরে মোটা মোটা সব ডাক্তারির বই, নোটস পড়ে আছে।”
আর তার বাবা বলছিলেন, ছোটবেলা থেকেই খুব নিয়ম মেনে চলত আমার মেয়ে। চিরকাল বাংলা মাধ্যমের সরকারি স্কুলে পড়েছে। “নাইন-টেন থেকেই কখন কোন সাবজেক্ট পড়বে, কী পড়বে, সব আগে থেকে ছক কষা থাকত ওর। পড়াশোনা নিয়েই থাকত, আর বিশেষ কোনো আগ্রহ ছিল না,” বলছিলেন ওই চিকিৎসকের বাবা।
পড়াশোনা নিয়ে সময় কাটত তার, তবে গান গাইতেন তিনি একসময়ে। পরে ডাক্তারি পড়তে গিয়ে সময়ের চাপে আর সেভাবে গান গাওয়ার সময় পেতেন না বলে জানিয়েছেন তার প্রতিবেশী।
“ওর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ এক বসন্ত উৎসবে,” বলছিলেন ওই তরুণী চিকিৎসকের দুটো বাড়ি পরেই থাকেন এমন একজন নারী। তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, “খুব ভাল গান গাইত, জানেন! ইনফ্যাক্ট এ পাড়ায় বিয়ে হয়ে আসার পরে ওকে আমি প্রথম দেখি বসন্ত উৎসবে একটা গান গাইতে। কী গান গেয়েছিল, সেটাও মনে আছে। অসমীয়া বিহুর গান ‘বিহুর এ লগন, মধুর এ লগন’ গানটা গেয়েছিল ও।”
তিনি এও বলছিলেন, “একটা সময়ে আমার হারমোনিয়ামটা কাছে ছিল না। তখন ও-ই একদিন বলল ‘বৌদি, তুমি আমার হারমোনিয়ামটা নিয়ে যাও। আমার তো সময় হয় না বিশেষ!”
আসছে নভেম্বর মাসে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল ওই তরুণী চিকিৎসকের।
তার মেয়ের ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চেয়ে যেভাবে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমেছে, তাতে মনের জোর পাচ্ছেন ওই চিকিৎসকের বাবা। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, “এখন কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। প্রথমদিকে প্রমাণ নষ্ট করার অনেক চেষ্টা হয়েছে, তার কিছু প্রুফ আমাদের কাছে আছে। ওইরকম একটা খবর পেয়ে আমরা কী তখন প্রমাণ রাখার চেষ্টা করব না কী মেয়ের কী অবস্থা সেদিকে মন দেব! কিন্তু বিচারাধীন বিষয় যেহেতু, তাই এর বেশি কিছু বলা যাবে না।”
তিনি অভিযোগ করেছেন, “তবে ওর ডিপার্টমেন্ট আমাদের সঙ্গে একদমই সহযোগিতা করেনি। কিন্তু এরকম যে একটা কিছু হতে যাচ্ছে, সেটা ও-ও আঁচ পায়নি, আমরাও কিছু বুঝিনি। হাসপাতালের ব্যাপারে বাড়িতে যেটুকু যা কথাবার্তা বলত, তাতে এরকম যে কিছু হতে পারে, সেটা বোঝাই যায়নি আগে,” জানাচ্ছিলেন ওই চিকিৎসকের বাবা।
কিন্তু এখন তার মেয়ের ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চেয়ে যেভাবে মানুষ পথে নেমেছেন, তাতে মনোবল বেড়েছে ওই চিকিৎসকের পরিবারের, পাড়া-প্রতিবেশীদের।
আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক ভুয়া কথাও ছড়ানো হচ্ছে, ছবি শেয়ার করা হচ্ছে, এগুলোও ব্যথিত করছে পরিবারকে, প্রতিবেশীদের। “এত প্রতিবাদ, বিচারের দাবিতে সারা পৃথিবীতে মিছিল, এসব দেখে এখন আমাদের মনে হচ্ছে যে লড়াইটা হয়তো জিতব আমরা,” জানাচ্ছিলেন ওই চিকিৎসকের এক প্রতিবেশী।
তার কথায়, “ওর বিচার হলে ভবিষ্যতে অন্য মেয়েদের সুরক্ষিত রাখতে পারব আমরা। আমাদের সেটাই পাওনা হবে।”