মোঃ সেলিম উদ্দিন (কক্সবাজার)
চলতি মৌসুমে দেশে লবণ উৎপাদন হয়েছে ১৮ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন। যা গত ৬১ বছরের ইতিহাসে রেকর্ড। অনুকূল আবহাওয়া, চাষ যোগ্য জমি এবং চাষির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় রেকর্ড লবণ উৎপাদন হয়েছে । আমদানি বন্ধে লবণের ন্যায্যমূল্য পাওয়ায় হাসি ফুটেছে প্রান্তিক চাষিদের মুখে।
তবে অভিযোগ উঠেছে, মিল মালিকদের একটি সিন্ডিকেট লবণ মজুদের মাধ্যমে দেশে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি এবং লবণ আমদানির পাঁয়তারা করছে। লবণ আমদানির পাঁয়তারার বিষয়টি খতিয়ে দেখবে বলে জানিয়েছে বিসিক।
সরেজমিনে কক্সবাজার সদর উপজেলার ইসলামপুরে ঘুরে ও চাষিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বৃষ্টিতে শেষ লবণ উৎপাদন মৌসুম। যার কারণে খালি পড়ে আছে একরের পর একর মাঠ। অধিকাংশই জলমগ্ন। তবে চাষিদের অনেকেই গর্ত করে লবণ মজুদ করেছেন মাঠে। রোদ পেলে সেই লবণ উত্তোলন, বিক্রি ও মিলে স্থানান্তরের পালা চলছে এখন। আবার অনেকেই ট্রাক ও ট্রলারযোগে লবণের চালান সরবরাহ করছেন সারাদেশে।
ইসলামপুরের খানঘোনা এলাকার লবণ চাষি শহীদুল ইসলাম রাসেল বলেন, বিগত ৩/৪ বছরের তুলনায় এ বছর ভালো লবণ উৎপাদন হয়েছে। দামও বেশি পাচ্ছি। আমি ১৬ কানি জমিতে লবণের চাষ করেছিলাম। সেখানে প্রায় ৪ হাজার মন লবণ উৎপাদন হয়েছে। ইতোমধ্যে দেড় হাজার মন বিক্রি করেছি। বাকিগুলোও মজুদ করে রেখেছি। যা বিক্রি করতে পেরেছি তাতে ভালোই লাভ হয়েছে। প্রায় একই কথা জানিয়েছেন স্থানীয় অনেক চাষি।
এদিকে লবণের উৎপাদন রেকর্ড ছাড়িয়ে গেলেও পূরণ হয়নি দেশের চাহিদা। আর গেলো মৌসুমের অবশিষ্ট অবিক্রিত লবণ মজুদ রয়েছে প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টন। সব মিলিয়ে এসব লবণ দিয়ে দেশের চাহিদা পূরণ সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবুও মিল মালিকদের একটি সিন্ডিকেট লবণ মজুদের মাধ্যমে দেশে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি এবং লবণ আমদানির পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাস্ট্রির পরিচালক আবিদ আহসান সাগর বলেন, লবণ আমদানি বন্ধ থাকার কারণে চাষিরা এ বছর বেশ লাভবান হয়েছে। যারা লোকসানের কারণে ইতোপূর্বে লবণ চাষ থেকে সরে গিয়েছিল তারা লবণ চাষে আবারও উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
তিনি বলেন, আমরা যারা কক্সবাজারে লবণ চাষের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছি, আমরা ঢাকা-নারায়নগঞ্জ ও চট্টগ্রামে এ লবণ বিক্রি করি। এ মুহুর্তে দেশে লবণের সংকটের কোন সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা এখন শুনতে পাচ্ছি যারা লবন মজুদ করছেন তারা দেশে একটা কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা করছেন আমদানি করার জন্য। যদিও আমদানির কোন প্রয়োজন নেই। যেহেতু সাত মাস পরেই আমাদের লবণ উৎপাদন শুরু হবে। যারা লবন আমদানির পাঁয়তারা করছে তাদের বিরুদ্ধে যদি সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থা অভিযান চালায় তারা এগুলো আর করতে পারবে না।
কক্সবাজার লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি শামশুল আলম আজাদ বলেন, আমাদের বিসিক যে চাহিদা নির্ধারণ করছে তাদের কাছে আমারও প্রশ্ন প্রতি বছর কেন লবণের চাহিদা ২ লাখ/৩ লাখ মেট্রিক টন বাড়ছে? আমাদের কি শিল্প প্রতিষ্ঠান বাড়ছে? না মানুষের চাহিদা বাড়ছে? তবে আমি চাষিদের ধন্যবাদ জানাই। এ বছর তারা উৎপাদনে ৬১ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছেন। আমরা আশা করি এ লবণ শিল্পের স্বার্থে, আমরা যারা মিলার আছি এবং এই লবণ শিল্পের সাথে যারা জড়িত আছি তাদের স্বার্থে সরকার বিষয়টিকে আন্তরিকভাবে দেখবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের মিলগুলোতে প্রত্যাশিত পরিমান লবণ মজুদ আছে। চাষিদের কাছেও ভালোই লবণ আছে। আমি মনে করি আমরা যদি সুন্দর ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে যাই উৎপাদিত এই লবণ দিয়েই সারা দেশের চাহিদা পূরণ সম্ভব।
তবে লবণ শিল্পের উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) উপ-মহাব্যবস্থাপক মোঃ জাফর ইকবাল ভুঁইয়া বলছেন, প্রান্তিক লবণ চাষিদের স্বার্থ রক্ষায় আমরা কাজ করছি। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও লবণ আমদানির পাঁয়তারার বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখবো। এ বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি এবং মনিটরিং করছি।
মোঃ জাফর ইকবাল ভুঁইয়া বলেন, লবণ আমদানির প্রয়োজন নেই বলেই গত বছর সরকার আমদানির অনুমোদন দেয়নি। এই কারণে চাষিরাও উৎসাহিত হয়ে মাঠে নেমেছেন। এ বছর বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ লবণ উৎপাদিত হয়েছে। বাজার পরিস্থিতিও যথেষ্ট ভালো। চাষিরা বেশ খুশি, তারা নায্য মূল্য পাচ্ছেন। আমরা আশা করছি, আগামীতেও উৎপাদনের এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
এ বছর কক্সবাজার এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় ৬৩ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ চাষ করেছেন ৩৭ হাজার ২৩১ জন চাষি। চলতি মৌসুমে লবণের চাহিদা ২৩ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন হলেও উৎপাদিত হয়েছে ১৮ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন। ২০২০-২১ মৌসুমে লবণ উৎপাদন হয়েছিল ১৬ লাখ ৫০ হাজার ৮২০ মেট্রিক টন।