ওয়াসা এমডির বেতন বিলাস!
অনলাইন ডেস্কঃ ২০১০ সালের ১৪ অক্টোবর ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পাওয়ার সময় তাকসিম এ খানের মাসিক বেতন ধরা হয়েছিল এক লাখ ২০ হাজার টাকা। গত ১১ বছরে তিন দফায় তার বেতন বেড়ে এখন হয়েছে ছয় লাখ ২৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রতি মাসে উৎসব বোনাস বাবদ প্রায় অর্ধলাখ টাকা, স্পেশাল পে (বিশেষ ভাতা) হিসেবে প্রায় দুই লাখ টাকা এবং প্রতি মাসে বৈশাখী নববর্ষ ভাতা হিসেবে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা যুক্ত করে এত টাকা তার মাসিক বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে। এমডির এই অস্বাভাবিক বেতন বৃদ্ধিতে ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষোভমিশ্রিত বিস্ময় :যে হারে এমডির বেতন বেড়েছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন তো তার ধারেকাছেও নয়!
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা সমকালকে বলেন, গত পাঁচ বছর তার কোনো বেতন বাড়ানো হয়নি। যদি প্রতিবছর ৭ শতাংশ হারে বেতন বাড়ে, তাহলে এটা অস্বাভাবিক নয়। তা ছাড়া এ ব্যাপারে ওয়াসা বোর্ডের সদস্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সেলিনা আক্তারকে দিয়ে কমিটি করা হয়েছিল। ওই কমিটিই এই বেতন নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বিষয়টি বোর্ডে ওঠার পর আমাদের মনে হয়েছে, যেহেতু কমিটিই ঠিক করেছে, কাজেই আমাদের আর এ ব্যাপারে বলার কিছু নেই।
গোলাম মোস্তফা আরও বলেন, ‘এমডি সাহেব চেয়েছিলেন, সর্বশেষ গত অক্টোবরে তার যখন পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন থেকে এই নতুন বেতন কার্যকর করা হোক। কিন্তু আমরা বলেছি, বোর্ডে পাস হওয়ার পরই এটা কার্যকর হবে, তার আগে নয়।’
তিনি আরও বলেন, বর্তমান এমডি অনেক পরিশ্রম করছেন। উনি অনেক যোগ্য ব্যক্তি। এ জন্য তার বেতন বৃদ্ধি করা হলেও বোর্ডে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ভবিষ্যতে নতুন কেউ এমডি নিয়োগ পেলে তার ক্ষেত্রে এই ছয় লাখ ২৫ হাজার টাকা মাসিক বেতন কার্যকর হবে না। অন্য কেউ নতুন করে এমডি হলে তার বেতন এর চেয়ে কম হবে।
ঢাকা ওয়াসার এমডির বেতন বৃদ্ধি সম্পর্কিত ফাইলপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এমডি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার সময় তার মূল বেতন ছিল ৬০ হাজার টাকা। উৎসব-ভাতা ছিল ১০ হাজার, বাসাভাড়া ২০ হাজার, চিকিৎসা-ভাতা চার হাজার, আপ্যায়ন-ভাতা চার হাজার ও অন্যান্য ভাতা ছিল ২২ হাজার টাকা। সাকল্যে বেতন ছিল এক লাখ ২০ হাজার টাকা।
ওই বছরের শেষ দিকে তার বেতন বিভিন্ন খাতে আরও ৮০ হাজার টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় দুই লাখ টাকা। এরপর ২০১৬ সালে এক ধাপে বাড়িয়ে করা হয় চার লাখ ৫০ হাজার টাকা। ওই সময় কোনো স্পেশাল পে ছিল না।
সর্বশেষ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের ২৭৬তম সভায় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বেতন বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা করা হয়। সেখানে বোর্ডের তরফ থেকে বলা হয়, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, মুদ্রাস্ম্ফীতি ও ঢাকা ওয়াসার ব্যাপক অগ্রগতির ক্ষেত্রে অবদান ইত্যাদি বিবেচনা করে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বেতন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। পরের মিটিংয়ে মাসিক বেতন ছয় লাখ ২৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়। ওই প্রস্তাবে মূল বেতন ধরা হয় দুই লাখ ৮৬ হাজার টাকা, বাসাভাড়া ৩৫ হাজার, চিকিৎসা-ভাতা ৩৫ হাজার ৭০০, আপ্যায়ন-ভাতা ৩৫ হাজার ও বিশেষ ভাতা ধরা হয় এক লাখ ৮০ হাজার ৬৬ টাকা। এ ছাড়া প্রতি মাসে উৎসব-ভাতা ধরা হয়েছে ৪৭ হাজার ৬৬৭ টাকা। প্রতি মাসে বাংলা নববর্ষ ভাতা ধরা হয়েছে চার হাজার ৭৬৭ টাকা। এ দুটি ভাতাই প্রতি মাসে তিনি পাবেন। এসব মিলিয়ে তার বেতন হয়েছে ছয় লাখ ২৫ হাজার টাকা।
এরপর ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের ২৭৮তম বোর্ড সভায় সে প্রস্তাব পাস করা হয়। গত ২৫ মে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের বেতন বৃদ্ধির দাপ্তরিক যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করে অফিস আদেশ জারি করে। সেখানে বলা হয়, মে মাস থেকে এই বেতন কার্যকর হবে।
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করায় তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলা সম্ভব হয়নি। হোয়াটসঅ্যাপ-ভাইবারে কল দিলেও তিনি ফোন ধরেননি।
কোন কোম্পানির এমডির বেতন কত :সরকারি ও আধা-সরকারি খাতে বাংলাদেশের প্রথম সারির কোম্পানি জনতা ব্যাংকের এমডির মাসিক বেতন চার লাখ টাকা, সোনালী ব্যাংকের এমডির চার লাখ, রূপালী ব্যাংকের এমডির চার লাখ, বিডিবিএলের এমডির দুই লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) এমডির বেতন দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশের (পিজিসিবি) এমডির বেতন তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা। ডেসকোর এমডির বেতন দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) এমডির বেতন এক লাখ ১০ হাজার টাকা। এ ছাড়া সরকারের আওতাধীন অন্য যেসব কোম্পানি রয়েছে, সেসব এমডির বেতনও এ রকম বা এর চেয়ে কম বলে জানা গেছে।
ঢাকা ওয়াসার একজন কর্মকর্তা জানান, ওয়াসার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ওই মন্ত্রণালয়ে একজন সিনিয়র সচিব, একজন প্রতিমন্ত্রী এবং একজন পূর্ণ মন্ত্রী রয়েছেন। তাদের সবার বেতনও ওয়াসার এমডির বেতনের চেয়ে কম। আর কাগজে-কলমে এবার এমডির বেতন সোয়া ছয় লাখ টাকা করা হলেও তিনি আরও অনেক সুবিধা ভোগ করেন। সীমাহীন জ্বালানি, চালকসহ সার্বক্ষণিক বিলাসবহুল গাড়ি পান। অনেক সময় একটির পরিবর্তে দুটি গাড়িও তিনি ব্যবহার করেন। এ ছাড়া সীমাহীন মোবাইল ও টেলিফোন বিল পান। এ রকম আরও অনেক সুবিধাই তিনি পান। অথচ কর্মচারীদের বেতন এই হারে বাড়ানো হয় না। এতে কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ ও হতাশ।
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, এত বেশি বেতন বৃদ্ধির বিষয় অবিশ্বাস্য এবং অযৌক্তিক। কী প্রক্রিয়ায় এবং কার সিদ্ধান্তে এটা করা হয়েছে, এটা কর্তৃপক্ষের অনুসন্ধান করা উচিত। আমরা আমাদের গবেষণায় দেখেছি, ওয়াসার কাছ থেকে নগরবাসীর যে সেবা পাওয়ার কথা, ওয়াসা সেই সেবাগুলো নগরবাসীকে দিতে পারেনি। এ ছাড়া ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনও হয়তো এই হারে বাড়েনি। এ অবস্থায় ওয়াসার তদারককারী সংস্থা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হবে বিষয়টি তদন্ত করা। পাশাপাশি উচিত হবে, এটা জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা।
ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সদস্য বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, বোর্ডে এমডির বেতন বৃদ্ধি নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল। কারণ, অন্য কোম্পানিগুলোর এমডির এত বেতন না। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করে বলেছেন, বাড়ানো যেতে পারে। পরে আর কেউ আপত্তি করেনি।
জানা গেছে, একই সঙ্গে এবার ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বোর্ড সদস্যদের মাসিক সম্মানী অল্প পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে। সূত্রঃ সমকাল