সড়ক দূর্ঘটনা কমাতে আমাদের করনীয়

বিশেষ রচনা বলি শিক্ষা
শেয়ার করুন...

তাসফীর ইসলাম (ইমরান):
মনে রাখতে হবে সবাইকে, ছোট্ট একটা ভুল মানুষের সারা জীবনের জন্য কান্না বয়ে আনতে পারে।
বর্তমানে বাংলাদেশে সেরকম একটি অসতর্কমূলক কাজ হচ্ছে সড়ক দূর্ঘটনা।
যা প্রতি সেকেন্ড, প্রতি মিনিটে হতেই যাচ্ছে। দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।

বাংলাদেশে নিরাপদ সড়ক আইন পাশের পর প্রায় দুই বছর পার হতে চললেও এখনো আইনটি পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।

দু’হাজার আঠারো সালের ২৯শে জুলাই ঢাকার দুই কলেজ শিক্ষার্থী সড়কে বাস চাপায় প্রাণ হারানোর পর শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ১৯শে সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন আইন পাস করে সরকার।

একই বছর সেপ্টেম্বরে আইনটি পাশ হলেও সেটি কার্যকর করা হয় পরের বছর পহেলা নভেম্বর থেকে।
কিন্তু, সেটার কোনো প্রয়োগ দেখি না বললেই চলে।

বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যায়,

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে প্রায় ২০ হাজার লোক মারা যায়। যদিও পুলিশের দেয়া তথ্যে দেখা যায় এ সংখ্যা অনেক কম। যেসব দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর মামলা হয়েছে, এমন হিসাব থেকেই পুলিশ তথ্য সরবরাহ করে এছাড়া স্থানীয়ভাবে মীমাংসা হয়ে যাওয়া কিংবা গ্রামাঞ্চলের অনেক দুর্ঘটনার তথ্য পুলিশ খুব কমই সংরক্ষণ করে। আবার গণমাধ্যমেও সব দুর্ঘটনার খবর প্রকাশিত হয় না। যার কারণে প্রকৃত সংখ্যা আড়ালেই থেকে গেলেও তা যে কতটা ভয়াবহ তা সচেতন মহলমাত্রই জানেন।

নিরাপদ সড়ক চাই এটা নিয়ে আমরা যতই আন্দোলন করি না কেন।
আমাদের দেশে সে আন্দোলন করে কোনো লাভ। নিজ থেকে সতর্ক না হওয়া পর্যন্ত সড়ক দূর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাবার কোনো উপায় নেই।

সাধারনত সড়ক দূর্ঘটনা হলে-
সড়ক দুর্ঘটনার জন্য আমরা প্রায় সবাইকে নির্দিষ্ট কয়েকটি কারণকে চিহ্নিত করতে দেখি।

যেগুলো হলো-

যেমন-

১। হাইওয়েতে ডিভাইডার না থাকা।
২। সড়ক সংস্কারসহ সুষ্ঠু সড়ক ব্যবস্থাপনার অভাব।
৩। নির্ধারিত স্টপেজে না থেমে সংযোগগুলোতেই যাত্রী ওঠানামা করা।
৪। যথাযথ শাস্তি না হওয়ায় দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ভয় না থাকা।
৫। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিদ্যমান আইনগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ না করা।
৬। আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও পরিবহনে লাগানো হয়নি গতি নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র।
৭। চালকদের অনেকের রোড সিগন্যাল, ট্রাফিক সাইন সম্পর্কে কোন ধারণা নেই।
৮। হাইওয়েতে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ ওভারলোডিং, ওভার স্পিডিং এবং ওভারটেকিং।
৯। আন্তঃজেলা সড়ক ও মহাসড়কে দ্রুত গতির পাশাপাশি কম গতির যানবাহন চলাচল।
১০। ইদানীং দেখা যায় গাড়ি চালক গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলছেন যা তার মনঃসংযোগে বাধা প্রদান করে।
১১। রেলওয়ের প্রায় আড়াই হাজার লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে গেট ব্যারিয়ার ও গেটম্যান রয়েছে মাত্র ৩৭০টিতে। অবশিষ্ট লেভেল ক্রসিং অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। আর অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংগুলোতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে।

সড়ক দূর্ঘটনা হয় আমাদের নিজেদের অসতর্কতার কারনে।

কারনগুলো হলোঃ

দুর্ঘটনাগুলোর প্রধান কারণসমূহ কি কিঃ

১/ ফুট ওভার ব্রিজ ব্যাবহার না করা।
২/ পথে পথে বাজার করার নতুন সংস্কৃতি।
৩/ পথচারীদের ডানপাশ দিয়ে না হাটার প্রবণতা।
৪/ যাত্রীদের অ সহিস্নুতা এবং দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর মানসিকতা।
৫/ জেব্রা ক্রসিং না থাকা স্বত্বেও আমরা অহরহ ঝুঁকি পূর্ণভাবে রাস্তা পার হই।
৬/ নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডের বাইরে যত্রতত্র রাস্তার ওপর গাড়ি দাঁড় করিয়ে ওঠানামা করা।
৭/ ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়া একটি কারণ সেইসাথে কোথাও কোথাও ব্যাবহার উপযোগী ফুটপাত থাকা স্বত্বেও ব্যাবহার না করার প্রবণতা।
৮/ অসংখ্য পথচারী মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতেই ব্যস্ত রাস্তা পাড় হন। এমনকি আমরা হেড ফোন, ব্লুটুথ হেড ফোন কানে দিয়ে গান শুনতে শুনতে ব্যস্ত রাস্তায় চলাফেরা করছি।
৯/ মটর সাইকেল আরোহীরা রাস্তায় বেরই হন আইন না মানার প্রতিজ্ঞা করে। তাদের আইন অমান্য করার প্রবণতা আমাদের শিক্ষার দৈন্যতার এক ক্যানভাসে পরিণত হয়েছে। কেননা আমার ধারনা মটর সাইকেল আরোহীদের ৯০% ই শিক্ষিত।

একজন গাড়িচালকের দৃষ্টিতে দুর্ঘটনার কারণ সমুহঃ

১/ দেশের সব হাইওয়ে টুওয়ে, যা প্রায়শই দুটি গাড়ীকে মুখোমুখি করে দেয় এবং এতে ওভারটেকিং খুবি ঝুঁকিপূর্ণ।
২/ বিশ্বের সব দেশে রোড সাইনগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমাদের দেশে হাইওয়েতে অপ্রতুল রোড সাইন চালককে রাস্তার ব্যাপারে সম্যক ধারনা দিতে পারেনা।
৩/ ভালো ব্রেকিং এর জন্য যে অমসৃণ রাস্তা তৈরি হচ্ছে তা শুধু ট্রাক বা বাসের মত বড় থ্রেডের চাকার জন্য ভালো, ছোট চাকার গাড়ী যেমন কার বা মাইক্রো-বাসের এত বড় থ্রেড হয়না ফলে আকস্মিক ব্রেক করলে গাড়ী স্কীড করে দুর্ঘটনায় পতিত হয়।
৪/ হাইওয়ের পাশে যত্রতত্র দোকানপাট, বাজার গড়ে ওঠার ফলে রাস্তা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। এর সাথে যেখানে সেখানে ট্রাক বা বাস পার্কিং করে রাখার ফলে রাস্তা সরু হয়ে দ্রুতগামী গাড়ীকে ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে।
৫/ প্রতিটি মোড় বা রেল ক্রসিং ইত্যাদিতে সাধারণ যানবাহন যেমন বাস, টেম্পো ইত্যাদি রেখে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা রেখে দূরপাল্লার যানবাহনকে অযথা দেরী করিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং এর ফলে চালকেরা অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন ।
৬/ ট্রাকগুলোর ওজন মাপার ব্যবস্থা চিরকাল নষ্ট করে রাখার ফলে ৫/৭ টন বহন করার কথা থাকলেও ট্রাকগুলো নিম্নে ১০টন এবং ঊর্ধ্বে ২২/২৩ টন পর্যন্ত বহন করছে। অবধারিত ভাবে রাস্তা এই পরিমাণ লোডের কথা ভেবে তৈরি না হবার ফলে প্রতিটি জেলা শহর হতে বেরোবার রাস্তায় দেখা যায় বাম দিকের রাস্তা ভেঙ্গে গেছে বা দেবে গেছে। এই ভাঙ্গাচোরা রাস্তা দুর্ঘটনা ঘটার পিছনে অন্যতম একটি কারণ।
৭/ দেশের সব হাইওয়েতে দেখা যায় যে অসংখ্য পুল, কালভার্ট ও ব্রিজ রয়েছে, এবং এর প্রতিটি এপ্রোচ এমনভাবে তৈরি যে রাস্তার থেকে তা অসমান বা গ্যাপ রয়েছে যার ফলে গাড়ীগুলো এখানে উঠতে গিয়ে হঠাৎ ব্রেক করতে হয় এবং প্রায়শই দুর্ঘটনায় পড়ে, এছাড়া এগুলো এমনভাবে বানানো হয়েছে যে বড় আকারের দুটো গাড়ী কোনভাবে ক্রস করে তাই সামান্য ভুলচুক হলেই ঘটে বড় দুর্ঘটনা।
৮/ রাস্তায় যত্রতত্র স্পীড ব্রেকার তৈরি করা হয়েছে যা প্রয়োজনের তুলনায় উঁচু এবং তাতে না আছে কোন সাইন বা আলাদা রঙ করা। ফলে অনেক সময় দ্রুতগতির গাড়ী বেকায়দা অবস্থায় পড়ে এবং অবধারিত ভাবে দুর্ঘটনায় পড়ে।
৮/ বিশ্বের সব দেশে অতিবৃষ্টি বা কুয়াশার সময় রাস্তায় ফ্লুরোসেন্ট রঙ্গে মধ্য রেখা ও দুই পার্শে ফগলাইন দেয়া হয় যা অল্প আলোতে বা বাধাপ্রাপ্ত ভিশনেও গাড়ী চালাতে প্রচণ্ড সহায়তা করে। আমাদের দেশেও এটা দেয়া হয়, কিন্তু রাস্তা তৈরির সময় দেয়া হয় যা আর পরবর্তীতে রিপেয়ার করা বা নতুন করে দেয়া হয়না যার ফলে হাইওয়েতে গাড়ীগুলো লেন মেইন্টেন করতে বা কিনারার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বুঝতে পারেনা, এর ফলে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে।
৯/ রাতে চলা দূরপাল্লার বাস বা ট্রাকেরা দুইটি হেডলাইটের স্থলে ৩ থেকে ৬ টি হেডলাইট ব্যবহার করে, যার ফলে বিপরীত দিক থেকে আসা ছোট গাড়ী রাস্তার কিছুই প্রায় দেখতে পায়না, আন্দাজের উপর চালাতে হয় তখন, এমন অবস্থায় যদি হঠাৎ ভাঙ্গা রাস্তা বা সামনে কোন মানুষ বা কিছু পড়ে তাহলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে।
১০/ আমাদের দেশের হাইওয়েতে যত্রতত্র মানুষ বা গরুছাগল, কুকুর ঘুরে বেড়ায়, এদের কারণে যে কত দুর্ঘটনা ঘটে তার কোন ইয়াত্তা নেই। দুর্ঘটনা হলে চালক এর বা মালিকের সাজা হয়, গাড়ীর ক্ষতি হয় কিন্তু কখনোই হাইওয়েতে নিজের বাড়ীর উঠান মনে করে ঘুরে বেড়ানো মানুষ বা গরুছাগল মালিকের সাজা হয়না।

হাইওয়েতে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে প্রয়োজন:

১/ হাইওয়েতে ডিভাইডার না থাকা।
২/ সড়ক সংস্কারসহ সুষ্ঠু সড়ক ব্যবস্থাপনা।
৩/ প্রতিটি দুর্ঘটনার যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা।
৪/ নির্ধারিত স্টপেজ ব্যতিরেকে যাত্রী ওঠানামা না করা।
৫/ গাড়ি চালানো অবস্থায় গাড়ি চালকের কাছে মোবাইল ফোন না রাখা।
৬/ চালকদের রোড সিগন্যাল, ট্রাফিক সাইন সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়া।
৭/ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিদ্যমান আইনগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করা।
৮/ হাইওয়েতে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ ওভারলোডিং, ওভার স্পিডিং বন্ধ করা।
৯/ চালকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন।
১০/ রেলওয়ের প্রায় প্রতিটি লেভেল ক্রসিংয়ে গেট ব্যারিয়ার ও গেট ম্যানের ব্যবস্থা করা।
১১/ আদালতের নির্দেশনা-নুযায়ী পরিবহনে গতি নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র লাগানো বাধ্যতামূলক করা।
১২/ বিআর টি এ কে রাজনীতি মুক্ত করা। এবং শ্রমিক নেতাকে আর যাই হোক অন্তত মন্ত্রিত্ব না দেয়া।
১৩/ আন্তঃজেলা সড়ক ও মহাসড়কে দ্রুত গতি এবং কম গতির যানবাহনের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা।
১৪/ দুর্ঘটনা রোধে একদিকে যেমন চালককে ট্রাফিক আইন মানতে হবে অন্যদিকে ট্রাফিক পুলিশকেও তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
১৫/ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একজন চালককে মালিকের নির্দেশে সারা দিনের পর রাতেও গাড়ি চালাতে হয়। ক্লান্তিতে নুয়ে পড়া শরীর-মন নিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন তাঁরা। এ জন্য সড়ক দুর্ঘটনা রোধে মালিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি।

গতিসীমার দিকে নজর দিলের সড়ক দূর্ঘটনা অনেকটাই কমে যাবে।

গাড়িচালকদের নির্দিষ্ট গতিসীমা অতিক্রমের প্রবণতা
গাড়িচালকদের গতি বাড়ানোর প্রবণতা পরিবহন গবেষকদের জন্য একটি মাথাব্যথার বিষয়। উন্নত দেশগুলোতে ২০০৪-০৭ এর মধ্যে গাড়ির গতি বৃদ্ধির হার প্রায় ৫০% পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। গবেষণায় দেখা গেছে যে, গাড়ির গতি যদি নিয়ন্ত্রণের ভেতর রাখা যায়, তাহলে ২৫% এর মতো মৃত্যুর হার কমে যাবে, ১৮% এর মতো ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা এবং ১০% এর মতো স্বল্পমাত্রার দুর্ঘটনা কমে যাবে।

এই পদক্ষেপগুলি গ্রহণ খুব কি ব্যয়সাধ্য বা অসম্ভব? তা কিন্তু নয়। প্রয়োজন সচেতনতা, সদিচ্ছা সর্বোপরি দায়িত্ববোধ। যা আমাদের সড়ক দুর্ঘটনা ও এর দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারে অর্ধেকে।

লেখকঃ তাসফীর ইসলাম (ইমরান) শিক্ষার্থীঃ সার্ভে ইঞ্জিনিয়ারিং, বাসাই৷


শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published.