পদ্মা নদীর নাম এসেছে হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর নামানুসারে!

আরো বিশেষ প্রতিবেদন বিশেষ রচনা বলি সাহিত্য
শেয়ার করুন...

সোহেল সানিঃ সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটালো সরকার। পদ্মা নদীর নামেই “পদ্মা সেতু” নামকরণ হলো। শেখ হাসিনার নামানুসারে সেতুটির নামকরণ হলো না। সর্বশেষ দাবিটিও অগ্রাহ্য করেছেন সয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবশ্য প্রথম থেকেই প্রধানমন্ত্রী বলে আসছিলেন তাঁর নামে সেতুটির নামকরন হোক তা তিনি চান না। প্রস্তাবটি মন্ত্রিসভায়ও উঠছিল, কিন্তু তিনি তা নাকচ করে দেন। সড়কপরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে করা সর্বশেষ প্রস্তাবটিতেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সায় দিলেন না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে যে, পদ্মা নদীর নামেই “পদ্মা সেতু” ২৫ জুন শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করা হবে। তবে জানা যায়নি কেন কী কারণে সেতুটির নাম “পদ্মা সেতু” রাখা হলো? কেনো প্রবল জনদাবি সত্ত্বেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজের নামানুসারে সেতুটির” নামকরণ করলেন না তাও জানা যায়নি। “পদ্মা সেতু” নামকরণে ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী নির্বিকার থাকায় ধন্যবাদ পেতেই পারে। কারণ নিশ্চয়ই তারা জানেন পদ্মা বাংলাদেশের প্রধান নদী। হিমালয়ে উৎপন্ন গঙ্গানদীর প্রধান শাখা এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর রাজশাহী এই পদ্মার উত্তর তীরে অবস্থিত। নামটি যে লক্ষ্মী দেবীর নামানুসারেই রাখা। এই তো সেদিনও দেখলাম, মূর্তি-ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে ইসলামের নামে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে কত ধ্বংসাত্মক তৎপরতা। জাতির পিতার ভাস্কর্য উচ্ছেদের হুঙ্কারও আমরা শুনেছি ইসলামি লেবাসধারী অনেকের বয়ানে। পদ্মা সেতুর নামকরণ নিয়ে এদের মাথাব্যথা নেই। দুটি কারণে এটা হতে পারে। এক, পদ্মা লক্ষ্মী দেবীর নামানুসারে হলেও এটা অতি প্রাচীন কালের মীমাংসিত বিষয়- এতে জনগণের সমর্থন মিলবে না। দুই পদ্মা নামকরণপর প্রতিবাদে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার মানেই হবে শেখ হাসিনার নামানুসারেই সেটা করার পথ প্রশস্ত করে দেয়া এজন্যই মৌলবাদিরা নিশ্চুপ। যাক তারা সাধুবাদ পেতেই পারে। অন্তত সরকারকে ঝামেলা পোহাতে হলোনা। উৎসবমুখর পরিবেশেই উদ্বোধন হচ্ছে।
“পদ্মা নামের উৎপত্তি”
পদ্মা নদীর নামের উৎপত্তি হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর নামানুসারে। লক্ষ্মীর আরেকটি নাম পদ্মা। পদ্ম ফুলের মাঝে প্রকাশিত বলেই লক্ষ্মী দেবীর হাতে পদ্মফুল লক্ষ্য করা যায়। দেবী লক্ষ্মীর অবতার হলো পদ্মা দেবী বা পদ্মাবতী । ইতিহাস বলছে বঙ্গদেশ মানে প্রাচীন বাংলা বৌদ্ধ ও হিন্দু অধ্যুষিত ছিল। হিন্দু- বৌদ্ধ শাসকবর্গের নামে যেমন গড়ে ওঠে শহর বন্দরের নাম তেমনিভাবে দেবদেবীর নামে নামকরণ করা হয় নদীর। যেমন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা প্রধান এই তিনটি নদী হিন্দুদের তিন দেবীর নামানুসারে রাখা হয়। মেঘনা নদীর নাম দেবী গঙ্গার নামানুসারে রাখা হয়েছে। মেঘনা হলো গঙ্গা দেবীর একটি অবতার। মেঘের দেবী মেঘনা। হিন্দুরা গঙ্গা দেবীকে মেঘের দেবীও বলে। পদ্মা নদী (Padma River) মূলত গঙ্গার নিম্ন স্রোতধারার নাম, আরও নির্দিষ্টভাবে বলা যায় গোয়ালন্দ ঘাটে গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গম স্থলের পরবর্তী মিলিত প্রবাহই পদ্মা নামে অভিহিত। বাংলাদেশে গঙ্গার প্রবেশ স্থল (নবাবগঞ্জ জেলাধীন শিবগঞ্জ উপজেলার মানাকোসা ও দুর্লভপুর ইউনিয়ন) থেকে নদীটি পদ্মা নামে বহুল পরিচিত। এই নামটি (পদ্মা) গঙ্গা নদীর ডান তীর থেকে বিভক্ত হয়ে আসা ভাগীরথী নামক শাখাটির উৎসস্থল পর্যন্ত ব্যবহূত হয়, এবং হিন্দুমতে এই ধারাটিই গঙ্গার ধর্মীয় পবিত্রতা বহন করে। নদীজ ভূমিরূপ বিদ্যাগতভাবে যমুনার সাথে সঙ্গমস্থলের পূর্ব পর্যন্ত প্রবাহটিকে গঙ্গা নামে এবং সঙ্গমস্থল পরবর্তী নিম্নস্রোতধারাকে পদ্মা নামে অভিহিত করা অধিকতর সঠিক। পদ্মা কখনো কখনো ভুলবশত গঙ্গা নামে উল্লিখিত হয়। ব্রহ্মপুত্রের স্থানান্তরিত প্রবাহের ফলে এই নদীখাতের সৃষ্টির কারণে শুধুমাত্র নয় বরং বৎসরের অধিকাংশ সময়ে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা গঙ্গার তুলনায় পদ্মার প্রবাহে অধিকতর ভূমিকা রাখে। পদ্মা ১২০ কিমি দীর্ঘ এবং ৪ থেকে ৮ কিমি প্রশস্ত। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গোয়ালন্দ-চাঁদপুর স্টিমার চলাচল পথের অধিকাংশই এই নদী জুড়ে। গোয়ালন্দ ঘাট থেকে ১৪ কিমি দূরে টেপাখোলার কাছে এর ডান তীর থেকে বেরিয়ে আসা ছোট একটি শাখার নাম ফরিদপুর খাল। আরও ৫০ কিমি ভাটিতে ডান তীর থেকে আড়িয়াল খাঁ নদীর সৃষ্টি হয়েছে। আরও ১৪ কিমি ভাটির দিকে বাম তীরবর্তী লোহাগঞ্জে, লোহাগঞ্জ খাল পদ্মায় পতিত হয়েছে এবং অপর তীর থেকে শাখা নদী ক্রিস্টানগরের উৎপত্তি হয়েছে। এ স্থান থেকে কয়েক কিলোমিটার নিম্নে ডান তীর থেকে শোশাখাল এবং নড়িয়াখাল উৎপন্ন হয়েছে, পরে দুটি ধারা মিলিত হয়ে একটি স্রোতধারা হিসেবে মাদারিপুরের দক্ষিণে আড়িয়াল খাঁয় পতিত হয়েছে। সুরেশ্বর থেকে ৫ কিমি দূরে ঈষৎ জল মগ্ন চড়া ও চরের স্থানান্তরের জটিল একটি অঞ্চলে পদ্মা মেঘনার সাথে মেলে। নিম্ন মেঘনা মূলত পদ্মার একটি ধারাবাহিকতা। গঙ্গা-পদ্মা হল প্রধান জলশক্তি (hydrodynamic) প্রণালী পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ ভূমি গড়ে তুলেছে যা দেশের একটি বিরাট অংশ এবং ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বৃহত্তর একটি অংশ অধিকার করে আছে। গাঙ্গেয় বদ্বীপের উন্নয়নের দীর্ঘ ইতিহাসে, নদীটি দক্ষিণপূর্ব দিকে সরে এসেছিল এবং বঙ্গের নিম্নভূমির বর্তমান অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম অংশে গঙ্গা বদ্বীপের জলবিদ্যা এবং নিষ্কাশন প্রণালী প্রমত্তা গঙ্গা এবং বঙ্গ অববাহিকার নদীজ জল সংস্থান ব্যবস্থার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা নদীর বদ্বীপ মোহনা প্রণালীর মাধ্যমে এইসব নদী প্রণালী সমূহের মিলিত অপসারিত পানি নিষ্কাশনের পরিমাণ গড়ে ৩৫,০০০ কিউমেক। অবশ্য, বর্ষা মৌসুমে পদ্মার অপসারণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৭৫০,০০০ কিউমেক এ দাঁড়ায় এর সাথে সাথে পলি বহনের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। পদ্মার নিম্ন পর্যায়ের অপসারণের পরিমাণ ১৫,০০০ কিউমেক, এবং এ সময়ে স্বাভাবিকভাবে খুব সামান্য পরিমাণ পলি বাহিত হয়। নদীটির বদ্বীপ অংশে প্রশস্ততার পরিসীমা ১.৬ থেকে ৮ কিমি এবং মাঝেমাঝে এর বিনুনী বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় যদিও এটি একটি আকাবাঁকা নদীখাত। মেঘনা নদীর নাম রাখা হয় দেবি গঙ্গার নামানুসারে। মেঘনা হচ্ছে গঙ্গা দেবীর একটি অবতার। মেঘের দেবী মেঘনা।

বাংলা বানানে কখনো নদ ও কখনো নদী লেখা হয়। নিয়মটা হলো যদি নামের পিছনে আ-কার, ই-কার বা এই জাতীয় কিছু থাকে তাহলে নদী হবে। যেমনঃ মেঘনা নদী, পদ্মা নদী, আড়িয়ালখা নদী, আড়পাংশিয়া নদী। কিন্ত যদি নামের পিছনে আ-কার, ই-কার বা এই জাতীয় কিছু না থাকে, তখন নদ হবে। যেমনঃ ব্রহ্মপুত্র নদ, কপোতাক্ষ নদ। জলস্রোত কোনো পর্বত, হ্রদ, প্রস্রবণ ইত্যাদি জলাধার হতে উৎপন্ন ও বিভিন্ন জনপদের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অন্যকোনো জলাশয়ে পতিত হয়, তাকে নদী বলে। যেমন পদ্মা,মেঘনা, যমুনা, সুরমা, গঙ্গা, বুড়িগঙ্গা ইত্যাদি নদী।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক।


শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published.