লায়লা খন্দকারঃ দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুরা ঘরে বন্দী। ফলে তাদের মানসিক চাপ বাড়ছে।
‘সম্প্রতি আমার ছেলে হঠাৎ রেগে যাচ্ছে, যা আগে কখনো হতো না,’ বলেন ১৩ বছরের এক শিশুর মা। সম্প্রতি বাংলাদেশের অনেক মা-বাবা কোভিড-১৯-সংক্রান্ত বিধিনিষেধের কারণে সন্তানদের আচরণে পরিবর্তন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। মহামারির অভিজ্ঞতার কী প্রভাব ভবিষ্যতে শিশুদের জীবনে পড়বে, তা নিয়ে তাঁরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
‘ইমপ্যাক্ট অব কোভিড-১৯ প্যানডেমিক অন দ্য মেন্টাল হেলথ অব চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ: আ ক্রস-সেকশনাল স্টাডি’ (চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়ুথ সার্ভিসেস, অক্টোবর ২০২০) থেকে জানা যায়, শিশুরা বিষণ্নতা, উদ্বেগ এবং ঘুমের সমস্যায় ভুগছে। মাঝারি এবং গুরুতর মানসিক সমস্যার হার যথাক্রমে ১৯ দশমিক ৩ ও ৭ দশমিক ২ শতাংশ।
দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুরা ঘরে বন্দী। চারদিকে মৃত্যু এবং উৎকণ্ঠা। পরিচিত জীবন হারিয়ে এবং বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের মানসিক চাপ বাড়ছে। কঠিন পরিস্থিতিতে শিশুদের প্রতিক্রিয়া বড়দের থেকে আলাদা হয়। কেউ কেউ দ্রুত মানিয়ে নেয়। আবার অনেকে মা-বাবাকে আঁকড়ে ধরতে চায়, নিজেকে গুটিয়ে রাখে, রাগ বা অস্থিরতা প্রকাশ করে।
এক সাক্ষাৎকারে ন্যান্সি ক্লোজ (ইয়েল স্কুল অব মেডিসিনের চাইল্ড স্টাডি সেন্টারের সহকারী অধ্যাপক এবং ইয়েল প্রোগ্রাম ইন আর্লি চাইল্ডহুড এডুকেশনের সহযোগী পরিচালক) জানান, ‘অনেক শিশুর বিকাশ পিছিয়ে যাচ্ছে বা তারা এমন আচরণ করছে, যা তাদের বয়সের উপযোগী নয়। কেউ কেউ বয়সের তুলনায় ছোট শিশুদের মতো কথা বলছে, কারও-বা ব্যক্তিগত কাজে সহায়তার প্রয়োজন হচ্ছে, যা আগে দরকার হতো না। কোভিড-১৯ মহামারির অনিশ্চিত সময়ে শিশুরা উদ্বিগ্ন ও হতাশা বোধ করতে পারে, যা তাদের আচরণগত সমস্যার জন্য দায়ী।’
সম্প্রতি ৭ থেকে ১৫ বছর বয়সী ১০ থেকে ১২টি শিশুর সঙ্গে আলোচনার সুযোগ হলো। তারা নিজেদের মতো করে ভালো থাকার চেষ্টা করছে। তবে বাসায় থাকতে থাকতে তারা স্বাভাবিকভাবেই হাঁপিয়ে উঠেছে। মা-বাবা যাতে তাদের সঙ্গে আরেকটু বেশি সময় কাটান, সে বিষয় তুলে ধরল কয়েকজন। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শিশুরা বড়দের ভালোবাসা আর মনোযোগ একটু বেশি চায়। মা-বাবাকে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিদিনের রুটিন অনুযায়ী কাজগুলো যত দূর সম্ভব মহামারির আগের মতোই বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে নতুন পরিকল্পনায় কাজ করে যেতে শিশুদের সাহায্য করা দরকার। শিশুদের বই পড়া, খেলা, ছবি আঁকা, বাগান করাসহ নান ধরনের কাজে সক্রিয় রাখতে হবে, যাতে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কমে। মা-বাবাকেও ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনে সময় কাটানো কমাতে হবে, কারণ শিশুরা বড়দের দেখেই শেখে।
দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুরা ঘরে বন্দী। চারদিকে মৃত্যু এবং উৎকণ্ঠা। পরিচিত জীবন হারিয়ে এবং বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের মানসিক চাপ বাড়ছে।
গবেষণা থেকে জানা যায়, মা-বাবা সন্তানদের বয়সের উপযোগী ভালোবাসা ও নির্দেশনা দিলে তারা সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে। বিভিন্ন বয়সে শিশুদের অনুভূতি এবং চিন্তাভাবনা বোঝা প্রয়োজন। মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের কার্যকর যোগাযোগ যেকোনো সময় গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান মহামারিতে তা আরও বেশি জরুরি। শিশুদের প্রতিক্রিয়ার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে অনুভূতি নিয়ে বেশি প্রশ্ন করা উচিত নয়। তাকে আস্থা দেওয়া প্রয়োজন, যাতে সে বুঝতে পারে, বলতে চাইলে তার কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনা হবে।
কোভিড-১৯-এর লক্ষণ, কীভাবে এ ভাইরাস ছড়ায়, কীভাবে নিজেকে এবং অন্যদের রক্ষা করা যাবে, সে-সংক্রান্ত তথ্য মা-বাবা শিশুদের দেবেন। শিশুদের সামনে মহামারির খবর বারবার দেখা এবং এ নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করার দরকার নেই। কারণ, এতে তাদের অহেতুক উদ্বেগ বাড়বে। খবর পরিমিত পরিমাণে এবং বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পাওয়ার গুরুত্ব শিশুদের শেখানোর একটা সুযোগ এসেছে এ মহামারির সময়।
শিশু বা তার পরিবারের কেউ যদি অসুস্থ বোধ করে এবং হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়, তবে সেটি শিশুকে আগে থেকে জানিয়ে দিতে হবে। কোনো শিশু কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হলে যত দূর সম্ভব সংক্রমণের সব পর্যায়ে তাকে মা-বাবা এবং পরিবারের সঙ্গেই রাখতে হবে। হাসপাতালে ভর্তি, কোয়ারেন্টিন বা কোনো কারণে যদি আলাদা করতেই হয়, তবে টেলিফোন বা অন্য মাধ্যমের সাহায্যে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং শিশুকে নিয়মিত আশ্বস্ত করা প্রয়োজন।
শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে, যাতে স্কুল খোলার পর তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা দিতে পারেন। শিশুদের মানসিক সমস্যার লক্ষণগুলো বুঝে প্রয়োজনে রেফারেলের ব্যবস্থা করতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। স্বাভাবিক সময় ও দুর্যোগে শিশু সংবেদনশীল হওয়ার গুরুত্ব নিয়ে বড়দের সচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যম ভূমিকা রাখতে পারে।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক সতর্ক করে দিয়েছেন যে শিশুদের ভালো থাকা নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ‘এই প্রজন্মের শিশু এবং তরুণদের মানসিক সমস্যার ফলাফল স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর কোভিড-১৯ মহামারির তাৎক্ষণিক প্রভাবকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, যার পরিণতিতে দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে।’
কোভিড-১৯ শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এর ফল সুদূরপ্রসারী। এ পর্যন্ত শিশু অধিকার অর্জনে যা অগ্রগতি হয়েছে, তা আগামী দশকে পিছিয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম এবং শিশু নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রধান কারণের মধ্যে আছে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া এবং দীর্ঘদিন বিদ্যালয় বন্ধ থাকা। এখন আমরা যে সিদ্ধান্ত নেব, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। যদি আমরা শিশুদের জীবনে এ মহামারির নেতিবাচক প্রভাব দূর করতে আন্তরিক হই, তাহলে নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই শিশুদের অগ্রাধিকার দিয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পারিবারিক দারিদ্র্য মোকাবিলায় প্রয়োজন শিশু সংবেদনশীল সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষায় যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে, তা পুষিয়ে নিতে এ বিষয়কে জাতীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সবাইকে কাজ করতে হবে। শিশুসংক্রান্ত আইন, নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়নে জবাবদিহি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সমাজের সবাই নিজস্ব অবস্থান থেকে শিশুদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে এবং তাদের অনুভূতি বুঝে আচরণ করলে শিশুরা ভালো থাকবে।
● লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী