শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রতীকী কর্মসূচি হিসেবে সকাল ১০টা থেকে ১০টা ১ মিনিট পর্যন্ত মাত্র এক মিনিট নীরব রাখতে হবে ঢাকা। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে ওই এক মিনিট যান চলালচ বন্ধ রেখেছে ট্রাফিক বিভাগ। কিন্তু সরেজমিন বলছে, এক মিনিটও শব্দ দূষণমুক্ত ছিল না ঢাকা শহর।
ঘড়িতে তখন সময় রবিবার (১৫ অক্টোবর) সকাল ৯টা ৫০ মিনিট। হাইকোর্ট চত্ত্বর হয়ে শিক্ষা ভবনের দিকে যেতেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে স্কাউট সদস্যরা জানিয়ে দিলেন এই রাস্তায় এখন হর্ণ বাজানো নিষেধ। সচিবালয়ের কাছাকাছি যেতে এবার পুলিশও দিলো একই নির্দেশনা। সচিবালয়ের প্রধান ফটকের ঠিক বিপরীতে দেখা গেল ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন পরিবেশ মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সচিবসহ মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কর্মকর্তারা। সাথে আছে অর্ধশত স্কাউট সদস্য আরেকটু সামনে যেতেই দেখা গেল আরও কিছু স্কাউট সদস্য দাঁড়িয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন জিপিও থেকে হাইকোর্টমুখী সড়কটি। কারণ বন্ধ রাখতে হবে এখানকার শব্দ।
ততক্ষণে দশটা বাজতে আর বাকি মাত্র ২মিনিট। এবার জিপিও মোড়ের চারপাশের রাস্তাও বন্ধ করে দিলো সেখানকার দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। বন্ধ রাখা হলো ১০টা ২মিনিট পর্যন্ত। কারণ হিসেবে তারা জানালেন শব্দ দূষণ বন্ধ রাখতে এই উদ্যোগ। কিন্তু তখনো থেমে নেই শব্দের যন্ত্রণা। বন্ধ রাখার কারণ জানতে ট্রাফিক পুলিশকে লক্ষ্য করেই বারবার হর্ণ বাজাচ্ছিলেন গাড়ির চালকরা। ১০টা ২ মিনিটে সিগনাল ছাড়তেই শুরু হলো শব্দের বিষ্ফোরণ।
সব রাস্তা বন্ধ করে সচিবালয়ের সামনে মন্ত্রী-সচিবসহ পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যখন ১ মিনিট নিরবতা কর্মসূচি পালন করছিলেন সাউন্ড লেভেল মিটারে যাচাই করে দেখা যায়, তখনও সেখানকার শব্দ মান ছিল ৭০ ডেসিবেলেও উপরে। অথচ নির্ধারিত মানমাত্রা অনুযায়ী এখানে শব্দ থাকার কথা ৫০ ডেসিবেলের কম।
১ মিনিট নীরব রাখার নির্দেশনা দেওয়ার পরও কেন মানছে না জানতে চাইলে অধিকাংশ পরিবহন চালক দাবি করেন এক মিনিট নীরবতা পালনের নির্দেশনার কথা জানতেন না তারা। পরিবহন চালকদের এই তথ্য জানাতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি অভিযোগ করে অনেকে বলেন, যথাযথ প্রচারণার মাধ্যমে তাদের আগ থেকে সতর্ক করা গেলে এক মিনিট নয় সম্ভব ছিলো আরও দীর্ঘ সময় নীরব রাখা।
এই যখন পরিস্থিতি তখন ঢাকাকে ১ মিনিট নীরব রাখার এই কর্মসূচি কতটুকু সফল হয়েছে জানতে চাইলে হতাশা প্রকাশ করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন, এমপি। তিনি বলেন, ঢাকাকে শব্দ মুক্ত করা অত সহজ না। আমরা আজ এটি প্রতীকী কর্মসূচি হিসেবে পালন করেছি। এই এক মিনিটে ঢাকাকে শব্দ মুক্ত করা সম্ভব না। তবে এর মাধ্যমে আমরা মানুষকে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আগামীতে ৫, ১০, ১৫ মিনিট বা পর্যায়ক্রমে এক ঘণ্টাও কর্মসূচি পালন করতে পারি।
তিনি বলেন, শব্দ দূষণ যে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ও আইনত অপরাধ সেটা জনগণকে জানাতে গণমাধ্যম ভূমিকা রাখলে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর হলে ধীরে ধীরে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আমরা ধাপে ধাপে সেই চেষ্টা করবো।
যদিও শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারিত্ব মূলক প্রকল্প নামে ২০১৮ সালে পরিবেশ অধিদফতরের নেওয়া ৫ বছর মেয়াদী একটি প্রকল্প শেষ হতে যাচ্ছে আগামী ডিসেম্বরে। এই প্রকল্পের অধিনে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয়ে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়েছে নানান পদক্ষেপ। তবু কেনো এক মিনিটও শব্দমুক্ত রাখা গেল না এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশবাদীরা।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, এই কর্মসূচি সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো ঢাকায় আমরা এত বেশি দূষণ করছি যে এক মিনিটও নীরব রাখতে পারিনি। আমরা যতটুকু দেখেছি এই কর্মসূচির আগে পরিবেশ মন্ত্রণালয় সংবাদ সম্মেলন করে ও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জনগণকে সচেতন করতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু আরও বেশি প্রচারণা দরকার ছিলো। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কিছু প্রোগ্রাম করা দরকার ছিল। তাহলে মানুষ আরও বেশি জানতো এবং নীরবতা বাস্তবায়ন সহজ হতো।
যেহেতু এটি প্রতীকী কর্মসূচি তাই এটির শিক্ষা গ্রহণ করতে পারলে পরিবেশ অধিদফতর শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আরও শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারবে বলে জানিয়ে, জনসচেতনতার পাশাপাশি আইন প্রয়োগে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন এই বায়ুমান বিজ্ঞানী।
পরিবেশবাদী সংস্থা পরিবর্তন উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক, পরিবেশ ও জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ এম জাকির হোসাইন খান বাংলাভিশনকে বলেন, আমি পরিবেশ নিয়ে কাজ করি, অথচ পরিবেশ অধিদফতরের এই ১ মিনিট নীরব রাখার নির্দেশনা আমিও জানতাম না। আমার অফিসের গাড়ির চালকও জানতো না। শব্দ যারা করে সেই চালকদের কাছে বার্তা না পৌঁছে একটা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে এমন সমস্যা হবেই। এটার জন্য প্রয়োজন ছিলো তৃণমূল পর্যায়ে চালকদের সচেতন করা, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের সচেতন করে দেওয়া।
তিনি বলেন, যে কোনো প্রকল্প নেওয়ার আগেই সেই প্রকল্পের আউটকাম নির্ধারণ করা উচিত। একটা প্রকল্প শেষে জনগণের কোটি কোটি টাকা খরচ করে হতাশা প্রকাশ করলে তো জনগণের টাকা ফেরত দেওয়া যাবে না। কিন্ত পরিবেশ অধিদফতরের অধিকাংশ প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে প্রকল্প শেষে কোনো সুফলই পাচ্ছে না মানুষ। ৫ বছর ধরে একটা প্রকল্প চালিয়ে এতগুলো টাকা খরচ করে যদি ১টা গ্রামও শব্দ দূষণমুক্ত করা না যায় বা ঢাকাকে ১ মিনিটও নীরব রাখা না যায় তাহলে এই প্রকল্প নিয়ে নিঃসন্দেহে প্রশ্ন উঠবে।
সূত্রঃ বিভি