বাংলাদেশে অনেকেই ধীরে ধীরে পেট্রলচালিত মোটরসাইকেলের পরিবর্তে বেছে নিচ্ছেন ই-বাইক, শব্দের গর্জনের বিপরীতে বেঁছে নিচ্ছেন শব্দহীন গতি।
ই-বাইক কেনার পর ৩৪ বছর বয়সী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আরিফুর রহমানের জীবনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন শুধু জ্বালানি সাশ্রয় নয়, বরং নীরবতা। তিনি মুখে হাসি বললেন, "আগে যখন ১৫০ সিসির মোটরসাইকেল চালু করতাম, মেয়ে কান চেপে ধরত। এখন কোনো ঝামেলা ছাড়াই হাত নেড়ে বিদায় জানায়। এমনকি রাতে আমাকে চার্জ দেওয়ার কথাও মনে করিয়ে দেয় —যেন এটা তার খেলনা।"
এই ছোট্ট ঘরোয়া অভ্যাস আসলে বাংলাদেশের শহর ও শহরতলিতে এক বড় পরিবর্তনের প্রতীক। আরিফুরের মতো অনেকেই ধীরে ধীরে পেট্রলচালিত মোটরসাইকেলের পরিবর্তে বেছে নিচ্ছেন ই-বাইক, শব্দের গর্জনের বিপরীতে বেঁছে নিচ্ছেন শব্দহীন গতি। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানও সেই প্রবণতাকেই স্পষ্ট করে তুলছে।
একটি নীরব উত্থান
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, মাত্র তিন বছরে ই-বাইক আমদানি চার গুণ বেড়েছে। ২০২২–২৩ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল মাত্র ২ হাজার ৪৪৬টি, যার বাজারমূল্য ছিল ৯ কোটি টাকা। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৫৩টিতে, যার মূল্য ৪৭ কোটি টাকা।
বেশিরভাগ ই-বাইক সম্পূর্ণ প্রস্তুত অবস্থায় চীন থেকে আসে। তবে ২০–৩০ শতাংশ আসে খুচরা যন্ত্রাংশ আকারে, যা দেশে জোড়া লাগানো হয়। বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে রিভো ও ইয়াদেয়া। স্থানীয়ভাবে বাজার দখলে এগোচ্ছে ওয়ালটন, আকিজ, রানার অটোমোবাইলসসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও।
রিভো বাংলাদেশের বিপণন ব্যবস্থাপক ইনজামুল ইসলাম রিদম বলেন, "মাত্র এক বছরে রিভো বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ বৈদ্যুতিক দুই চাকার ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। আমরা বছরে ১০০ শতাংশেরও বেশি হারে বিক্রি বেড়ে যেতে দেখেছি। চাহিদা আছে—শুধু ই-বাইক সস্তা বলে নয়, এগুলো শহুরে জীবনের গতির সঙ্গে মানিয়ে যায় বলেও।"
যে কারণে রাইডাররা ই-বাইকের দিকে ঝুঁকছেন
ই-বাইকের আকর্ষণ মূলত হিসাবের খাতায় ধরা পড়ে। পেট্রলচালিত মোটরবাইকে প্রতি কিলোমিটারে খরচ ২ থেকে ৩ টাকা। ই-বাইকে খরচ মাত্র ১০ থেকে ৩০ পয়সা। রক্ষণাবেক্ষণও কম—ইঞ্জিন তেল লাগে না, জটিল যন্ত্রাংশ নেই, শুধু নিয়মিত বিদ্যুৎ বিলই যথেষ্ট।
আরিফুর বলেন, "মাসে প্রায় ৫ হাজার টাকা বাঁচছে। এটা আমার পুরো সংসারের বাজার খরচের সমান।"
রিদম বড় অঙ্কের হিসাব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "একটা ফুয়েল মোটরবাইক বছরে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা খরচ করায়—প্রায় নতুন ই-বাইকের দামের সমান। অথচ একটি ইভি চার্জ করতে মাসে লাগে মাত্র ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। পাঁচ বছরে পার্থক্য দাঁড়ায় ৪ লাখ টাকার বেশি। এটা শুধু সাশ্রয় নয়, অনেক পরিবারের জন্য আর্থিক মুক্তি।"
তিনি আরও জানান, বদলে যাচ্ছে ব্যবহারকারীর ধরণও। তিনি বলেন, "এটি সবচেয়ে দ্রুত গ্রহণ করছেন তরুণ পেশাজীবীরা, বিশেষ করে নারীরা। বাবা-মায়েরা নিশ্চিন্ত থাকেন, কারণ ইভির গতি নিয়ন্ত্রিত। গৃহিণী ও প্রবীণরাও সহজ ব্যবহারের কারণে ই-বাইক পছন্দ করছেন। এটি কেবল একটি বাইক নয়; এটি একটি জীবনযাত্রার পছন্দ।"
অর্থনীতির বাইরে—সাংস্কৃতিক পরিবর্তন
ই-বাইক শুধু অর্থনীতিকেই নয়, বদলে দিচ্ছে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও। কারও কাছে এগুলো পরিবেশবান্ধব জীবনযাপনের প্রতীক, আবার কারও কাছে আধুনিকতার পরিচয়। দোকানিরাও এ পরিবর্তন স্পষ্টভাবে টের পাচ্ছেন।
পেট্রলচালিত মোটরবাইক ও ই-বাইক দুটোই বিক্রি করেন আবুল কালাম। তিনি বলেন, "এই পরিবর্তনটা একদিনে আসেনি। শুরুতে আমি যখন কয়েকটা ই-বাইক দোকানে রাখতাম, বেশির ভাগ মানুষ সেগুলোকে গুরুত্বই দিত না। এখন ক্রেতারা দোকানে ঢুকেই ই-বাইক চেয়ে বসেন—আমার কাজ শুধু তাদের উপযুক্ত মডেলটা দেখিয়ে দেওয়া।"
রিদম এই প্রবণতাকে বৈশ্বিক প্রবণতার অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করে বলেন, "উত্তর আমেরিকা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া—সবখানেই বৈদ্যুতিক যানবাহন এখন মূলধারায় চলে আসছে। বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। নীতিমালার জন্য ভোক্তারা অপেক্ষা করছেন না, তারা প্রতিদিনের সুবিধা দেখে নিজেরাই ইভি বেছে নিচ্ছেন।"
ঢাকার নিয়মিত যাত্রী রুকসানা হোসেন একই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন। তিনি বলেন, "আমি সম্প্রতি একটা ই-বাইক কিনেছি। খরচ বাঁচানোর পাশাপাশি পরিবেশের জন্যও এটি অনেক ভালো। তাই পেট্রলচালিত স্কুটারের বদলে আমি ই-বাইক নিয়েছি। একজন যাত্রী হিসেবে পরিবেশ রক্ষায় আমারও কিছু করার ইচ্ছে আছে।"
চার্জিং–এর চ্যালেঞ্জ
তবুও কিছু বাধা রয়ে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা চার্জিং অবকাঠামো। বেশিরভাগ চালক বাড়িতেই চার্জ দেন, পুরো ব্যাটারি চার্জ হতে সময় লাগে ৭–৮ ঘণ্টা। দ্রুত চার্জিং করলে ৪০ মিনিটে সেটি সম্ভব, কিন্তু চার্জিং স্টেশন খুবই কম।
কালাম স্বীকার করেন, "প্রতিসপ্তাহে ক্রেতারা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, 'হাইওয়েতে চার্জ শেষ হয়ে গেলে কী হবে?' সেই ভয় থেকেই এটি কেনার ব্যাপারে ধীরগতি আছে।"
রিদমও এ ব্যাপারে একমত, তবে তিনি সুযোগ দেখতে পান। তিনি বলেন, "বাংলাদেশে যদি ব্যাটারি–সোয়াপিং নেটওয়ার্ক বা দ্রুত চার্জিং ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, এই বাজার হঠাৎই বেড়ে যাবে। ভাবুন তো, এক কাপ চা খাওয়ার সময়ের মধ্যেই যদি বাইক চার্জ হয়ে যায়—আমরা সেই ভবিষ্যতের দিকেই এগোচ্ছি।"
নীতিমালা ও সম্ভাবনা
সরকার দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে কর ছাড় দিয়েছে। ই-বাইক তৈরিতে শুল্ক কমানো হয়েছে। যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট ও অগ্রিম করও মওকুফ করা হয়েছে। এতে ওয়ালটনের মতো প্রতিষ্ঠান স্থানীয়ভাবে উৎপাদন শুরু করেছে।
ওয়ালটন ডিজি-টেকের প্রধান ব্যবসা কর্মকর্তা তৌহিদুর রহমান সরাসরি বললেন, "একটি ই-বাইক ব্যবহার করলে একটি পরিবার মাসিক জ্বালানি খরচ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে। দুই বছরে এই সাশ্রয় দিয়েই আরেকটি বাইক কেনা সম্ভব।"
রিদম আশাবাদী নীতিগত এই পদক্ষেপ নিয়ে। তিনি বলেন, "এ ধরনের প্রণোদনা পুরো খেলা বদলে দেবে। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সহজে প্রতিযোগিতা করতে পারবে, আমদানি নির্ভরতা কমবে। এটি শিল্প ও ভোক্তা—উভয়ের জন্যই লাভজনক।"
সামনে এগোনোর পথ
বিআরটিএ-র সরকারি তথ্য এখনও হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরে। দেশের ৬৫ লাখ নিবন্ধিত গাড়ির মধ্যে ৪৭ লাখই মোটরসাইকেল। অথচ এর মধ্যে বৈদ্যুতিক দুই চাকাওয়ালা বাইক মাত্র ২৬১টি। আরও হাজারো ই-বাইক রাস্তায় চলছে, কিন্তু সেগুলো অনিবন্ধিত।
তবে অগ্রগতি কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে শুরু হয় না। যেমন মোবাইল ব্যাংকিং একসময় ছিল প্রান্তিক, অথচ পরে বদলে দিয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। তেমনি ই-বাইকও ঘরে ঘরে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে।
আরিফুরের অভিজ্ঞতা সহজ। তিনি বলেন, "আমার মেয়ে খুশি, খরচ কমেছে, আর যাত্রা নীরব। আমার আর কী চাই?"
রিদমের জন্য বার্তা আরও স্পষ্ট। তিনি বলেন, "ভবিষ্যৎ বৈদ্যুতিক—এটা সরকার বা কোম্পানির কারণে নয়, মানুষ নিজেরাই বেছে নিচ্ছে বলেই। প্রতিটি নতুন রাইডার প্রমাণ করছে প্রযুক্তি কার্যকর। আর বিপ্লব শুরু হয় এভাবেই।"
যে দেশে দীর্ঘকাল ধরে মোটরসাইকেলের গর্জন শোনা যাচ্ছে, সেখানে অগ্রগতির আওয়াজ আসলে শব্দহীন।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সেলিম চৌধুরী হীরা কর্তৃক সম্পাদিত৷ https://www.dhurbar.com, ০১৯৭১-১০১৪২৯
Copyright © 2025 . All rights reserved.